যে সব শিল্পপতি পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করেছেন, তাঁদের কোনও সমস্যা নেই। কিন্তু আগে যাঁরা কখনও পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করেননি, তাঁদের রাজ্যে নিয়ে আসাটাই আসল পরীক্ষা বলে মনে করছেন বণিকসভা ফিকি-র নতুন সভাপতি সিদ্ধার্থ বিড়লা। তাঁর মতে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সেই লক্ষ্যে ইতিবাচক মনোভাব নিয়েই এগোচ্ছে। এখন দরকার শুধু গোটা কয়েক ‘সাকসেস স্টোরি’ বা সাফল্যের কাহিনি।
প্রশাসনিক ক্যালেন্ডার তৈরি করে কাজের স্বচ্ছতার পাশাপাশি তা শেষ করার জন্য সময় বেঁধে দিয়েছেন মমতা। সেখানে দেখা যাচ্ছে, শিল্প দফতরের ক্ষেত্রে কয়েকটি কাজের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন, শিল্পতালুকের পরিকাঠামো উন্নয়ন থেকে শুরু করে টাকা পাওয়ার সাত দিনের মধ্যে তালুকের জমি দিয়ে দেওয়া এবং একই সঙ্গে দ্রুত উৎসাহ-ভাতার ছাড়পত্র দেওয়া। মমতার এই সিদ্ধান্ত শিল্প ক্ষেত্রে বিনিয়োগের পথ তৈরি করার উপযোগী। নিজের শিল্পবান্ধব ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্রকে শিল্প দফতরের দায়িত্বও দিয়েছেন তিনি। ফিকি-র সভাপতি সিদ্ধার্থ বিড়লা মনে করছেন, এই পরিস্থিতিতে দরকার কয়েকটি ‘সাসকেস স্টোরি’, যা পশ্চিমবঙ্গে নতুন শিল্পপতিদের আগমনকে তরান্বিত করবে।
কী সেই সাফল্যের কাহিনি? তাঁর মতে, যেমন ধরা যাক দেশের প্রথম সারির শিল্পপতিরা পশ্চিমবঙ্গে প্রথম বারের বিনিয়োগ করতে আসছেন। মসৃণ ভাবে তৈরি হয়ে যাচ্ছে তাঁদের কারখানা। উৎপাদন শুরু হচ্ছে দ্রুত। কোথাও কোনও সমস্যা হচ্ছে না। এই ‘সাফল্যের কাহিনি’ দেখে বাকিরাও অনুপ্রাণিত হবেন। সিদ্ধার্থ বলেন, “আমার সঙ্গে এখনও পর্যন্ত এমন কারও দেখা হয়নি, যিনি পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করেছেন এবং তার জন্য হা-হুতাশ করছেন। কিন্তু আসল চ্যালেঞ্জটা হল, যাঁরা কোনও দিন পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগ করেননি, তাঁদের রাজ্যে নিয়ে আসা।” |
ফিকি সভাপতি সিদ্ধার্থ বিড়লা |
নতুন শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্রর নেতৃত্বে সেই পরীক্ষায় কি উতরোতে পারবে রাজ্য সরকার? আনন্দবাজারকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ফিকি-র সভাপতি বলছেন, “শিল্পায়নের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে আমলা স্তর পর্যন্ত সকলেই বন্ধু মনোভাবাপন্ন। নতুন বিমানবন্দর, সড়ক পরিকাঠামো যথেষ্ট ভাল। রাজারহাটে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প ও আবাসন ক্ষেত্রে যথেষ্ট কাজ হয়েছে। রাজারহাটের কিছু জায়গায় ঢুকলে তো গুড়গাঁও দিয়ে যাচ্ছি বলে মনে হয়।” কিন্তু রাজ্যের কর্মসংস্কৃতি? সিদ্ধার্থ বিড়লার যুক্তি, “রাজ্যের তরুণ প্রজন্মের মনোভাব যথেষ্ট ইতিবাচক। উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সমস্যা, অর্থসঙ্কটও রয়েছে রাজ্যের। যে শিল্পপতিরা রাজ্যে রয়েছেন, তাঁরা সেই সব সমস্যার কথা জানেন। নতুন যাঁরা বিনিয়োগ করতে আসছেন, তাঁদেরকে পরিস্থিতিটা বোঝাতে হবে।”
মুম্বইয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিল্প সম্মেলনে মুকেশ অম্বানীর মতো প্রথম সারির শিল্পপতিদের নিয়ে এসে সেই কাজটাই করেছিলেন অমিত। ওই সম্মেলনে এমন অনেকেই হাজির ছিলেন, যাঁরা পশ্চিমবঙ্গে এখনও বড় মাপের বিনিয়োগ করেননি। তাঁদের মধ্যে কত জন শেষ পর্যন্ত রাজ্যে লগ্নি করবেন, তা এখনও স্পষ্ট নয়। সিদ্ধার্থও বলছেন, “গুজরাত, মহারাষ্ট্র বা মধ্যপ্রদেশে বিনিয়োগ করতে গেলে পশ্চিমবঙ্গের তুলনায় অনেক কম ভাবনাচিন্তা করতে হয়।” কেন? সিদ্ধার্থের যুক্তি, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শিল্পনীতি নিয়ে এখনও শিল্পমহলে সংশয় রয়েছে। বিশেষ করে জমির প্রশ্নে। শুধু জমি অধিগ্রহণে অনীহা নয়, শহরাঞ্চলে জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন শিথিলের প্রশ্নে এখনও রাজ্য সরকারের আপত্তি রয়েছে। গ্রামেও সিলিং বহির্ভূত জমিতে ছাড়পত্র দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিটি আবেদন পৃথক ভাবে খতিয়ে দেখার ব্যবস্থা চালু রয়েছে।
সিদ্ধার্থ মনে করছেন, এই সব নীতিগত সমস্যা দূর করার ক্ষেত্রে মমতার সরকার নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে এগোচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী নিজে শিল্প সংক্রান্ত কমিটির নেতৃত্বে রয়েছেন। সেই কমিটিতে সমস্ত বণিকসভার প্রতিনিধিরা রয়েছেন। যাঁরা শুধু পশ্চিমবঙ্গ বা ভারত নন, গোটা বিশ্বের হালহকিকত সম্পর্কেই ওয়াকিবহাল। কাজেই প্রয়োজনীয় পরামর্শেরও অভাব হবে না। এখন শুধু সদিচ্ছাকে কাজে রূপ দিতে হবে। শিল্পমহলের একাংশের অভিযোগ, পশ্চিমবঙ্গে এখনও একটা শিল্প প্রকল্পকে দিনের আলো দেখতে হলে একাধিক ছাড়পত্রের পর্ব পার হতে হয়। তার ফলে অনেক সময় লেগে যায়। ফিকি-র সভাপতি বলেন, “যদি এটা নিশ্চিত থাকে যে নির্দিষ্ট সময়ের পরে কাজটা হবেই, তা হলে লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে কারও সমস্যা নেই।” রাজ্যে কিছু শিল্প-সহায়ক নীতি থাকলেও তার বাস্তবায়নের মধ্যে ফারাক রয়েছে বলেও শিল্পমহলের একাংশের মত। ফিকি-সভাপতি বলেন, “গুজরাতের সাফল্যের অনেকটাই দাঁড়িয়ে রয়েছে শিল্প-সহায়ক নীতির সঠিক রূপায়ণের উপর।”
তা করতে পারলেই নতুন বিনিয়োগকারীরা রাজ্যে আসবেন বলে সিদ্ধার্থর আশা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পদার্থবিদ্যায় স্নাতক হয়েছিলেন সুদর্শন কে বিড়লার পুত্র সিদ্ধার্থ। বর্তমানে তিনি এক্সপ্রো ইন্ডিয়া ও ডিগজাম লিমিটেডের চেয়ারম্যান। বাঁকুড়ার বড়জোড়ায় এক্সপ্রো-র কারখানার সম্প্রসারণের জন্য সম্প্রতি ২০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন তিনি। নতুন কারখানায় পরীক্ষামূলক উৎপাদনও শুরু হয়ে গিয়েছে। ফিকি-র সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার কিছু দিন আগেই নবান্নয় গিয়ে অমিত মিত্রর সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন সিদ্ধার্থ। সঙ্গে ছিলেন ফিকি-র প্রাক্তন সভানেত্রী নয়না লাল কিদোয়াই। সিদ্ধার্থ বলেন, “আমি অমিতকে বলেছি, কেন্দ্র তো বটেই, প্রত্যেকটি রাজ্যও নিজের এলাকায় বিনিয়োগ টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে। রাজ্যের দিক থেকে তাই বিনিয়োগ টানার জন্য নিজস্ব কৌশল থাকতে হবে। কারণ সব রাজ্যই দাবি করছে, তারাই শিল্পের জন্য আদর্শ গন্তব্য।”
শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে অমিত মিত্র বলেছেন, “টিম ওয়ার্কের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গে শিল্পোন্নতির চেষ্টা করে যাব।” সেই চেষ্টা হচ্ছে বলেই মনে করছেন সিদ্ধার্থ। তাঁর যুক্তি, অর্থমন্ত্রী হিসেবে অমিত গোটা কর আদায় ব্যবস্থাটাই অনলাইনে এনে ফেলেছেন। যার ফলে কর সংগ্রহের পরিমাণ
৩২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সিদ্ধার্থ বিড়লা বলেন, “প্রধানমন্ত্রী নিজে অমিতকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। রাজ্যের মোট উৎপাদন বৃদ্ধির হার জাতীয় হারের থেকে বেশি। ৯ শতাংশ। তার মানে অমিত মিত্র কর আদায় ব্যবস্থাকে আরও দক্ষ করে তুলেছেন। যে সব ফাঁকফোকর ছিল, সেগুলো বন্ধ করেছেন। একই ভাবে অন্যান্য যে সব ক্ষেত্রে অন্য রাজ্যগুলি ভাল কাজ করেছে, সেগুলিকেও উদাহরণ হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের অনুসরণ করা উচিত।” |