হারিয়ে যাওয়া মেয়েকে ফিরে পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছিলেন অনেক দিন আগেই। মানসিক প্রতিবন্ধী কন্যা বেঁচে রয়েছেন কি না, তা নিয়েও সংশয় ছিল। আড়াই বছর পরে লছমি ধানুককে ফিরে পেয়ে তার মা রামকলিদেবীর প্রথম প্রতিক্রিয়া, “আমার সংসারে লক্ষ্মী ফিরে এল।”
উত্তরপ্রদেশের উন্নাও জেলার বেথর গ্রামে রামকলিদেবীদের বাড়ি। তবে তাঁদের পরিবার দীর্ঘদিন কাটিয়েছেন উত্তর ২৪ পরগনার জগদ্দলে। সেখানকার ‘আলেকজান্ডার চটকলে’ কাজ করতেন লছমির বাবা শ্রীকুমার ধানুক। ২০০৭ সালে অবসর নেওয়ার পরে শ্রীকুমারবাবু সপরিবারে উন্নাও ফিরে যান। ২০১০ সালে সেখান থেকেই এক দিন হারিয়ে গিয়েছিলেন লছমি। মানসিক প্রতিবন্ধী লছমির কোনও খোঁজ তাঁরা তারপরে এতদিন পাননি। রামকলিদেবীর কথায়, “আমার চার সন্তান। তার মধ্যে লছমি মেজো। মানসিক ভারসাম্যহীন সেই মেয়ে হারিয়ে যাওয়ার পরে অনেক খুঁজেও না পেয়ে ওর সন্ধান আর কোনওদিনই পাব না বলেই ভেবেছিলাম।”
লছমিকে একা অসহায় অবস্থায় উদ্ধার করেছিল মালদহের পুলিশ।
কী ভাবে উন্নাও থেকে তিনি মালদহে পৌঁছেছিলেন, তা আর লছমির মনে নেই। পুলিশ তাকে আদালতে তোলে। আদালতের নির্দেশে সেই তরুণীকে পাঠানো হয় বহরমপুর মানসিক হাসপাতালে। এই হাসপাতালেই চিকিৎসার পরে আস্তে আস্তে সুস্থ হয়ে ওঠেন লছমি।
কিন্তু তখনও বাড়ির ঠিকানা বলতে পারতেন না। তবে উন্নাওয়ের কথা মাঝেমধ্যেই বলতেন। চটকলটির কথাও তাঁর মনে ছিল। |
ওই হাসপাতালের সুপার পবিত্রচন্দ্র সরকার বলেন, “লছমি বড় হয়েছেন ওই চটকলের পরিবেশেই। তাই অবচেতনে তাঁর মনে সেই চটকলের স্মৃতি ছিল।” সে কথা তিনি বলতে শুরু করতেই তাঁর ঠিকানার একটা হদিস তা থেকে মিলতে পারে ভেবে তাঁকে উৎসাহ দেওয়া হত। কিন্তু সেই চটকল কোথায়, তা জানতেও কেটে গিয়েছে অনেক মাস। বহরমপুর মানসিক হাসপাতালের রোগীদের শরীরচর্চা, গান গাওয়া, আঁকা ও সেলাই শিক্ষার প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতো কাজের দায়িত্বে রয়েছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘অঞ্জলি’। সেই সংস্থার কর্মীরাও লছমিকে উৎসাহ দিতেন। তাঁকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সাহায্য করেছেন।
এই উদ্যোগেই এক সময়ে লছমি জানাতে পারেন, চন্দননগরের নদীর ওপারে জগদ্দলের একটি জুট মিলে তাঁর বাবা এবং চার কাকা কাজ করতেন। কিন্তু উন্নাওয়ের ঠিকানা তখনও তিনি বলতে পারেননি। তবে ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্মীরা জগদ্দলে গিয়ে আলেকজান্ডার চটকল এলাকায় খোঁজ করে ধানুক পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে এমন ব্যক্তির সন্ধান পেয়ে যান। মিলে যায় বেথর গ্রামে ধানুক পরিবারের ঠিকানাও। সেখানে খবর দিতেই রামকলিদেবী ও তাঁর বড় ছেলে কৃষ্ণকুমার জানিয়ে দেন, তাঁরাই এসে লছমিকে নিয়ে যাবেন। সেই মতো শুক্রবার সকালে তাঁরা উন্নাও থেকে বহরমপুরে পৌঁছন। তাঁদের দেখে কেঁদে ভাসান লছমি।
পবিত্রচন্দ্রবাবু বলেন, “শেষ ছ’মাস দ্রুত আরোগ্যের পথে এগিয়েছেন লছমি। তিনি এখন সুস্থ।” লছমিকে নিয়ে রামকলিদেবীরা এ দিনই রওনা হয়েছেন উন্নাও।
উন্নাওর একটি মন্দিরে ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ সম্প্রতি সোনার সন্ধানে খননকার্য করেছিল। সোনা মেলেনি। সে কথা জানেন রামকলিদেবী। মেয়েকে নিয়ে ফেরার পথে বলে গেলেন, “আমি কিন্তু ফিরে পেলাম আমার হারিয়ে যাওয়া সোনার টুকরো সন্তানকে।” |