দেশের বিভিন্ন ধরনের চাকুরিতে নিয়োগ-বদলির পদ্ধতি লইয়া, সেই পদ্ধতির অনিয়ম ও দুর্নীতি লইয়া বিচারপতিরা অহোরাত্র নানা সমালোচনামূলক মন্তব্য করিয়া থাকেন। অনেক ক্ষেত্রেই সমালোচনা যথাযথ। কিন্তু বিচারপতি নিয়োগের নীতি ও পদ্ধতি লইয়া গুরুতর প্রশ্ন আছে। বিশেষত উচ্চ ন্যায়ালয়ের ক্ষেত্রে। সংবিধানে বলা আছে যে, রাষ্ট্রপতি হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের সহিত পরামর্শক্রমে শীর্ষ আদালতের বিচারপতিদের নিয়োগ করিবেন। কালক্রমে এই বিধানটির কার্যকর অর্থ দাঁড়াইয়াছে ইহাই যে, বিচারপতিরাই বিচারপতিদের নিয়োগ করিবেন। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, ১৯৯৮ সালে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত এই নিয়োগপদ্ধতি সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন। এই প্রেক্ষিতেই সাংবিধানিক বৈধতাসম্পন্ন বিচারবিভাগীয় নিয়োগ কমিশন গড়ার সিদ্ধান্তকে বিচার করিতে হইবে।
বিলম্বিত হইলেও সিদ্ধান্তটি স্বাগত। আশা করা যায়, ইহার ফলে বিচারপতিদের নিয়োগপ্রক্রিয়া অনেক বেশি স্বচ্ছ ও খোলামেলা হইবে। বিচারপতিরা নিজেরাই নিজেদের নিয়োগ করেন, এমন সমালোচনাও শুনিতে হইবে না। নিয়োগ কমিশনের শীর্ষে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির অবস্থান অস্বাভাবিক বা অন্যায্য বলা চলে না। তাহাতে কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রী, আইনমন্ত্রকের সচিব, শীর্ষ আদালতের অন্য দুই প্রবীণ বিচারকের সদস্যপদও অসংগত নয়। তবে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হইল প্রধানমন্ত্রী এবং লোকসভা ও রাজ্যসভার বিরোধী নেতাদের পরামর্শক্রমে মনোনীত দুইজন বিশিষ্ট ব্যক্তির অন্তর্ভুক্তি, যাহা কমিশনটিকে যথার্থ গণতান্ত্রিক প্রতিনিধিত্বে মণ্ডিত করিবে। অন্তত তত্ত্বগত ভাবে নিয়োগ কমিশনের গঠনের মধ্যে একটা ভারসাম্য রক্ষার প্রয়াস রহিয়াছে। তাহার পরেও অবশ্যই প্রশ্ন থাকে। যদি কোনও বিচারপতির নিয়োগ লইয়া কমিশন সদস্যরা একমত হইতে না পারেন, তবে সেই মতপার্থক্যের প্রভাব কী হইবে? গরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতেই কি এক জন বিচারপতি নিযুক্ত হইবেন, না কি সর্বসম্মতির চেষ্টা করা হইবে? বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্ব সমন্বিত প্রশ্নে শাসক ও বিরোধী পক্ষের মতৈক্য যেখানে দূরপরাহত, সেখানে বিচারপতি নিয়োগ লইয়াও বিরোধের শঙ্কা উড়াইয়া দেওয়া যায় না।
এই ধরনের কমিশন কতটা সফল হইবে, কেমন ভাবে কাজ করিবে, তাহা অবশ্য নির্ভর করিবে কমিশনের সদস্যদের উপরেই। কমিশন যাঁহারা চালাইবেন, তাঁহারা কেহই নাবালক নহেন, অপরিণতবুদ্ধিও নহেন। বস্তুত, বিচক্ষণতার জন্যই তাঁহারা সদস্য রূপে নিযুক্ত। সেই বিচক্ষণতা তাঁহাদের সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধির ঊর্ধ্বে উঠিতে সাহায্য করে কি না, তাহাই দেখিবার। দেশের বিচারব্যবস্থাকে নিরপেক্ষ, দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ ও জনসাধারণের প্রতি দায়বদ্ধ করিয়া তোলার জন্য বিচারপতিদের নিয়োগপদ্ধতিটি স্বচ্ছ হওয়া দরকার। যাঁহারা সেই গুরুতর কাজের দায়িত্ব পাইবেন, তাঁহাদের অবশ্যই যথাযথ যোগ্যতাসম্পন্ন হইতে হইবে এবং ঘোষিত যোগ্যতার প্রতি সুবিচার করিতে হইবে। সর্বোপরি, বিচারপতিরা যে প্রক্রিয়াতেই নিযুক্ত হউন, শেষ পর্যন্ত তাঁহারা কী ভাবে কাজ করিতেছেন, তাহা তাঁহাদের উপরেই নির্ভর করিবে। কোনও আইন, নীতি বা নিয়োগপদ্ধতিই সেই বিষয়ে নিশ্চয়তা দিতে পারে না। |