আম আদমি কাহাকে বলে, অরবিন্দ কেজরিওয়াল এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজিয়াছেন। তাঁহার মতে, আম আদমিকে যে গরিব হইতেই হইবে, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নাই। সৎ ও স্বচ্ছ প্রশাসন চাহেন, এমন যে কোনও ব্যক্তিই ‘আম আদমি’। দিল্লি বিধানসভায় কেজরিওয়ালের প্রথম ভাষণে যে কথাটি দ্ব্যর্থহীন ভাবে ফুটিয়া উঠে, তাহা হইল, যে ভঙ্গিতে রাষ্ট্রযন্ত্র চলিতেছে, ‘আম আদমি’ তাহাতে ক্ষুব্ধ। দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে কেজরিওয়ালের রূপকথাসম উত্থানের প্রধান চালিকাশক্তি ছিল এই ক্ষোভ। ক্ষোভ বহু রকমের। যথা, শাসনযন্ত্রের অচলায়তনে ধাক্কা খাইয়া ফিরিয়া আসিবার ক্ষোভ, ক্ষমতাবানদের সহিত সংযোগ না থাকিলে সামান্যতম পরিষেবা পাইতে ব্যর্থ হইবার পুনরাবৃত্ত অভিজ্ঞতাপ্রসূত ক্ষোভ। এই প্রেক্ষিতে বলা চলে, রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষমতার অলিন্দে যাঁহার প্রবেশাধিকার নাই, তিনিই ‘আম আদমি’। বিত্তশালী হওয়া সেই প্রবেশাধিকার অর্জনের একটি বড় পথ, একমাত্র নহে। ‘আনুগত্যের পরিবর্তে পাওয়াইয়া দেওয়া’র যে ব্যবস্থা ভারতীয় রাজনীতির প্রধান স্রোত হইয়া উঠিয়াছে, তাহাও ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশের একটি ছাড়পত্র। যাঁহার তেমন প্রবল বিত্তও নাই, আবার এই কিছু পাইবার যোগ্য হইয়া উঠিবার মতো আনুগত্য প্রকাশের সামর্থ্য বা অভিরুচিও নাই; রাজনৈতিক পরিচয় নাই, আবার উঁচুজাতের সরকারি চাকুরিও নাই, তিনিই ‘আম আদমি’।
এই সংজ্ঞা মানিলে ‘আম আদমি’-কে আর পেশা বা বিত্তের নির্দিষ্ট সীমায় বাঁধিয়া রাখা চলে না। বিদর্ভের তুলা চাষি হইতে কলিকাতার স্নাতকোত্তর স্তরের পড়ুয়া, বেঙ্গালুরুর তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী হইতে মুম্বইয়ের ডাব্বাওয়ালা, ‘আম আদমি’র বহু রূপ, বহু পরিচয়। তাঁহাদের যোগসূত্র কেবলমাত্র রাষ্ট্রক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশাধিকারহীনতায়। এবং, কী ভাবে এই অধিকার অর্জন করা চলে, বহু ক্ষেত্রেই তাহা একটি দীর্ঘমেয়াদি সন্ধান। কারণ, ক্রমে শাসনক্ষমতার নিকটবর্তী হওয়া এক দিকে সামাজিক উত্তরণের পথ, অন্য দিকে কিঞ্চিৎ অনায়াস জীবনযাপনের উপায়। কেজরিওয়াল দ্বিতীয় কারণটিকে স্বীকার করিয়াছেন। বস্তুত, রাষ্ট্রযন্ত্রের বন্ধ দরজায় নিষ্ফল ধাক্কা দেওয়ার ক্ষোভই যে ‘আম আদমি’কে ঘুরিয়া দাঁড়াইতে বাধ্য করিয়াছে, তাহাই তাঁহার একটি প্রধান প্রতিপাদ্য। কিন্তু, প্রথম কারণটিও অনস্বীকার্য। কী ভাবে এই ক্ষমতা অর্জন করা চলে, তাহারও দুইটি পথ আছে। কেজরিওয়ালরা প্রথম পথের পথিক, তাঁহারা মানুষের ক্ষোভকে যথার্থ ব্যবহার করিয়া গণতান্ত্রিক পথে শাসনক্ষমতায় আসিয়া তাহার সংস্কারের কথা বলিতেছেন। ইহা নিঃসন্দেহে কঠিনতর পথ। সহজ পথ হইল যে কোনও প্রকারে ক্ষমতাবানদের নিকটবর্তী হইয়া উঠিবার চেষ্টা করা টাকার জোরেই হউক বা মিছিলে পতাকা বহিয়া, আনুগত্যের বিনিময়ে অনুগ্রহ প্রাপ্তির পথটি মসৃণ করা। আপ-এর উত্থানের পরেও এই সাধারণ ছবি অপরিবর্তিত।
ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে ইহা এক দুঃসংবাদ। গণতন্ত্র, তাহার প্রাথমিক সংজ্ঞা অনুসারেই, সাধারণ মানুষের দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনার কথা বলে। তাহা এমন একটি ব্যবস্থা, যেখানে উচ্চাবচ ভেদ নাই, রাষ্ট্রের দৃষ্টিতে তাহার সব নাগরিক সমান। ভারতে এই সংজ্ঞাটি বহু পূর্বেই লঙ্ঘিত হইয়াছে। কিন্তু প্রকৃত দুঃখজনক ঘটনা হইল, সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এখনও সেই বিকৃতির অবসান দাবি করেন না। তাঁহাদের মূল কামনা, যে কোনও পন্থায় হউক, নিজেকে সেই বিকৃত ব্যবস্থার সহিত জুড়িয়া লওয়া, যাহাতে ন্যায্য এবং অন্যায্য সুবিধাগুলি পাইতে অসুবিধা না হয়। আনুগত্য-অনুগ্রহের পারস্পরিক সম্পর্ক এই কারণেই আজও এমন শক্তিমান এবং ফলিত রাজনীতির অধোগতিও অপ্রতিরোধ্য। সত্যই ‘আম আদমি’ ঘুরিয়া দাঁড়াইতে পারে কি না, ভারতীয় গণতন্ত্রের সুস্বাস্থ্য তাহার উপর বহুলাংশে নির্ভর করিয়া আছে। |