|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
মানবী যেখানে হয়ে ওঠে অনন্ত প্রকৃতি |
অ্যাকাডেমিতে অনুষ্ঠিত হল দ্বিজেন গুপ্তের একক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ। |
স্বতন্ত্র প্রকাশ-মাধ্যম হিসেবে ছবির সঙ্গে কবিতার ব্যবধান অনেকটাই। দুয়েরই রয়েছে নিজস্ব কিছু ঐশ্বর্য। নিজস্ব কিছু আলো-আঁধারি। হয়তো সে জন্যই একের প্রতি অপরের আকর্ষণ গভীর। কবিতার আছে জঙ্গমতার বিস্তীর্ণ আকাশ। আছে সময়ের প্রবহমানতার ভিতর দিয়ে চলা। ছবি এর বিপরীত। একটি নির্দিষ্ট পরিসরে সংস্থিত থাকাই তার ধর্ম। সেজন্যই দুইয়ের মধ্যে বিনিময় চলেছে অনাদি কাল থেকে। চিত্রশিল্পী ছবিতে আনতে চান কবিতার জঙ্গমতা। চিত্রকল্পের দৃশ্যগত সীমাকে বিস্তৃত করতে চান। কবি তাঁর কবিতায় মেলে ধরতে চান চিত্রের নিভৃত রহস্য, অন্তর্মুখীনতা। কবিতার আকাশ যেহেতু অনেক মুক্ত, তাই ছবিকে সে করে নিতে পারে তার প্রকাশের একটি প্রস্থানবিন্দু মাত্র। তার পর শুরু হয় তার নিজস্ব অভিসার।
ছবি ও কবিতার যুগলবন্দি নিয়ে দ্বিজেন গুপ্ত সম্প্রতি একক প্রদর্শনী করলেন অ্যাকাডেমিতে। ১৯৭০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত এই শিল্পী সব সময়ই কবিতার অনুরাগী। কবিতা অনুপ্রাণিত ছবি নিয়ে আগেও প্রদর্শনী করেছেন। তাঁর ছবিতে উদ্বুদ্ধ হয়েও কবিতা লিখেছেন অনেক কবি। ফলে আমাদের বুঝতে সুবিধা হয়, ছবি কী ভাবে আত্মস্থ করে কবিতার সারাত্সার আর কবিতাই বা কেমন করে ডানা মেলে ছবির উত্সভূমি থেকে। এই প্রদর্শনীতে ছিল মোট ৩০টি ছবি জলরং, অ্যাক্রিলিক ও মিশ্র মাধ্যমে আঁকা। এর মধ্যে ২১টি ছবি ও কবিতার যুগলবন্দি। কবিদের মধ্যে রয়েছেন শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেন্দ্র সেনগুপ্ত, পবিত্র মুখোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী, মল্লিকা সেনগুপ্ত, মন্দার মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। এই সব কবির কবিতাগুলো শিল্পীর অনেক আগের ছবির ভিত্তিতে বেশ কিছু দিন আগে লেখা। এ রকম ছবি ও কবিতার সংখ্যা ১২টি। বাকি ন’জন কবির কবিতা সম্প্রতি রচিত। তাঁরাও লিখেছেন ছবির প্রেরণায়। কবিরা ছিলেন হিন্দোল ভট্টাচার্য, মন্দাক্রান্তা সেন, নির্মল হালদার, পিনাকী ঠাকুর, শিবাশিস মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। |
|
শিল্পী: দ্বিজেন গুপ্ত। |
দ্বিজেনের ছবির অন্যতম বৈশিষ্ট্য, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মানবী-পরিস্থিতি বা মানবীচেতনা হয়ে ওঠে তাঁর ছবির বিষয়। মানবী জীবনকে ধারণ করে। অথচ জীবন তাঁকে প্রতিনিয়ত বঞ্চনা করে। এরই প্রতিবাদী প্রতিক্রিয়া অনেক সময়ই হয়ে ওঠে তাঁর ছবির উত্স। নারীকে তিনি প্রকৃতির সঙ্গে মেলান। তাঁর যন্ত্রণাকে উন্মীলিত করেন। আবার তাঁকে অসীমেও স্থাপন করেন। আলোচ্য ছবিগুলিতেও সেই কাজটিই তিনি নানা ভাবে করেছেন। তাঁর ছবির আঙ্গিকে স্বাভাবিকতাকে ভিত্তি করে তিনি যেমন অভিব্যক্তিবাদের দিকে যান, তেমনি অভিব্যক্তিবাদকে অতিক্রম করে নিয়ে আসেন কল্পরূপ। সেই কল্পরূপ পরিচিত বাস্তবকে ছাড়িয়ে অনেক সময়ই পরা-বাস্তবের (সুররিয়ালিজম) দিকে যায়। যাতে মানবী হয়ে ওঠে অনন্ত প্রকৃতি। বাস্তবের মানবীকে তিনি এই উজ্জীবনে পৌঁছে দিতে চান। তাঁর জলরঙের ব্যবহার, বিশেষত তসরের উপর, এই প্রক্রিয়ায় খুবই সাহায্য করে। অ্যাক্রিলিকেও অনেক সময় তিনি জলরঙের আবহ আনেন।
প্রতিবাদী চেতনা ও উজ্জীবনের আলো এই দু’টি অভিমুখকে ধরতে আমরা দু’টি ছবি বেছে নেব দৃষ্টান্ত হিসেবে। প্রথমটি তিনি এঁকেছিলেন ১৯৯৯ সালে। এর নিহিত আখ্যানের সঙ্গে মিলে গেছে শঙ্খ ঘোষের ‘কালযমুনা’ কবিতার অন্তর্লীন আলেখ্য।
‘বেচিস না মা বেচিস না
বেচিস না আমায়
ওরাও ছিঁড়ে খাবে, না হয়
তুই আমাকে খা।’ ছবিটি অতি উগ্রভাবে প্রতীকী। রয়েছে শঙ্কিতা, সন্ত্রস্তা নারী। আর তার পরিপার্শ্বে কঙ্কাল, করোটি, বলিদানের হাড়িকাঠ আর হিংস্র পাখি। দৃষ্টান্তের দ্বিতীয় ছবিটি শিল্পী এঁকেছিলেন ২০০৩ সালে। সম্মুখপটে এক যুবতীর আবক্ষ প্রতিমা। পশ্চাত্পটে রয়েছে এক স্থাপত্যের আভাস। ধাপে ধাপে সিঁড়ির উঠে যাওয়া। প্রচ্ছন্ন আলোকিত উদ্ভাসে আভাসিত এক মানবমুখ। নারীর প্রেম আর স্বপ্নের এক সম্মিলন পরিব্যাপ্ত হতে থাকে। কবি হিন্দোল ভট্টাচার্য এই ছবিটি থেকেই লিখেছেন এক বিষণ্ণতার কবিতা ‘হেমন্ত’ নামে।
‘এমন বিষণ্ণ দিন তোমাকে দেব না আমি আর
সবই তো হেমন্তকাল, এ বিকেল বড় দুঃখময়
তবু তুমি হাত ধরে আছ আমি বুঝতেও পারিনি...’ ছবিকে ঘিরে কবিতা কেমন করে উজ্জীবনের আকাশ তৈরি করে, এটি তারই দৃষ্টান্ত। কবিতার সফল চিত্রায়নে ছবিরও দায় থাকে কবিতাতে স্থিত থেকেও তাকে অতিক্রম করে বিস্তৃত এক পরিসর গড়ে তোলার। যে কাজটা কবিতা অনেক সহজে করতে পারে। কেননা তার সঙ্গে থাকে সময়ের ও ভাবনার বিস্তারের চতুর্থ মাত্রা। সে রকম বেশ কিছু যুগলবন্দির দৃষ্টান্ত আমরা এ প্রদর্শনীতে দেখি। |
|
|
|
|
|