কখনও চুপিসাড়ে তালা ভেঙে প্রাচীন মূর্তি হাপিস। কোথাও হুড়মুড় করে ঢুকে মারধর করে গয়নাগাটি নিয়ে চম্পট। কখনও আবার একই রাতে এক এলাকায় পরপর লুঠ।
জেলা জুড়ে নানা মন্দির-আশ্রমে একের পর এক দুষ্কর্ম ঘটে চলেছে গত কয়েক মাস ধরে। দিন-দিন এই ধরনের ঘটনা বেড়ে চললেও কিনারা হয়নি কোনওটির। এক দিকে কোনও ঘটনার কিনারা করতে না পারা, অন্য দিকে চুরি রোখার ব্যাপারেও ব্যর্থতার জেরে অস্বস্তিতে পুলিশ। বারবার এমন ঘটনায় বাড়ছে ক্ষোভও। রাস্তা অবরোধ, অবস্থান-বিক্ষোভ করছেন বাসিন্দারা। যে সব এলাকার মন্দিরে চুরি হয়েছে, সেখানকার বাসিন্দাদের নিয়ে কেতুগ্রামের অট্টহাস আশ্রমে একটি প্রতিবাদ সভাও ডাকা হয়েছে কাল, রবিবার।
গত জুনে কেতুগ্রামের নিরোলে কামাখ্যা মন্দিরের তালা ভেঙে চুরি যায় অষ্টধাতুর পুরনো মূর্তি। তারও আগে কেতুগ্রামের আমগোড়িয়া থেকে চুরি যায় সোনার রাধাকৃষ্ণ মূর্তি। জুলাইয়ে কেতুগ্রামেরই অট্টহাস আশ্রমের গর্ভগৃহ থেকে চুরি যায় দেবীমূর্তি। কিছু দিন আগে সেই অট্টহাস আশ্রমে ঢুকে সন্ন্যাসী-সহ কয়েক জনকে মারধর করে লুঠপাট চালায় দুষ্কৃতীরা। জামালপুরে এক রাতে আটটি মন্দিরে চুরি হয়। গলসির চান্না গ্রামে দুষ্কৃতীদের গুলিতে খুন হয়ে যান এক সন্ন্যাসী। মন্তেশ্বরের নানা মন্দির, পূর্বস্থলীর বুড়োরাজ মন্দিরেও চুরির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে অট্টহাস আশ্রমে মারধর করে লুঠের ঘটনায় সামান্য কিছু জিনিস উদ্ধার ও দু’জনকে গ্রেফতার এবং মন্তেশ্বরে তিন জনকে গ্রেফতার করা ছাড়া বাকি সব ক্ষেত্রেই অন্ধকারে পুলিশ।
দেবস্থানে চুরি করার সাহস আর কে দেখাবে, এই বিশ্বাসে ভর করে অধিকাংশ মন্দিরেই কার্যত অরক্ষিত অবস্থায় রাখা হয় পুরনো মূর্তি ও গয়না। কোথাও দরজায় একটি বা দু’টি তালা থাকে, কোনও মন্দিরে আবার তা-ও থাকে না। দানের গয়নাগাটি থেকে বাসনপত্র, অরক্ষিতই পড়ে থাকে সব। ফাঁকা জায়গায় থাকে বহু মূল্যবান মূর্তিও। সেবাইত পরিবারগুলির মতো পুলিশের একাংশেরও ধারণা, মন্দিরে চুরি করতে দ্বিধায় ভোগে দুষ্কৃতীরা। কিন্তু গত কয়েক মাসে গ্রামীণ বর্ধমানে এই বিশ্বাস ধাক্কা খেয়েছে বারবার। কোনও সূত্র খুঁজে পাচ্ছে না পুলিশ। তাই এগোচ্ছে না তদন্তও। পুলিশ সূত্রে খবর, জেলার পুলিশকর্তারা থানাগুলিকে বাড়তি সতর্ক থাকার জন্য বলেছেন। সম্প্রতি জেলার ‘ক্রাইম কনফারেন্স’-এ প্রতিটি থানার ওসি এবং আইসিদের মন্দিরে চুরির ঘটনার দিকে নজর রাখার পরামর্শ দিয়েছেন পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা। জেলার এক পুলিশকর্তা জানান, মন্দিরে চুরি রোখার ব্যাপারে জেলাস্তর থেকে নির্দিষ্ট কোনও নির্দেশ না দেওয়া হলেও সংশ্লিষ্ট থানাগুলি নিজেদের মতো করে ব্যবস্থা নিচ্ছে। এক পুলিশকর্তার কথায়, “একে ঘটনার কিনারা হচ্ছে না, অন্য দিকে চুরিও রোখা যাচ্ছে না। এই ঘটনা আমাদের অস্বস্তিতে ফেলছে।”
জেলার এক পুলিশকর্তা বলেন, “আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরগুলি সম্পর্কে কোনও তথ্যই নেই। রাস্তায় পড়ে থাকা ঐতিহাসিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ মূর্তিগুলির ব্যাপারেও কখনও চিন্তা-ভাবনা করা হয়নি।” কাটোয়া ও কালনা মহকুমায় বিভিন্ন সময়ে উদ্ধার হওয়া নানা যুগের কষ্টিপাথরের বিভিন্ন রকম মূর্তি খোলা আকাশের নীচে পড়ে থাকে, যা আন্তজার্তিক মূর্তি পাচার চক্রের কাছে লোভনীয়। স্থানীয় বাসিন্দারা সেগুলি পুজো করেন। ওই পুলিশকর্তা বলেন, “আমাদের যা পরিকাঠামো তাতে মন্দিরে মন্দিরে পাহারা দেওয়া সম্ভব নয়। তবে আগাম সতর্কতার ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। তবে সে জন্য আমাদের হাতে সম্পূর্ণ তথ্য থাকা দরকার।”
পুলিশের একাংশ মনে করে, এই সব মন্দিরের নিরাপত্তার অনেকটা নির্ভর করছে স্থানীয় বাসিন্দাদের সজাগ থাকার উপরেই। পুলিশ সূত্রে জানা যায়, প্রতিটি এলাকার যুবকদের নিয়ে দল গঠন করা হচ্ছে, যাঁরা মন্দির এলাকায় পাহারা দেবেন। কেতুগ্রাম থানার পুলিশ গ্রামবাসীদের সঙ্গে বৈঠক করে দেবদেবীর মূল্যবান জিনিসপত্র ব্যাঙ্কে রাখার পরামর্শ দিয়েছে। নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী বাড়িতে রাখার অনুরোধ করা হচ্ছে। পুলিশ জানায়, এর সঙ্গে টহলও বাড়ানো হচ্ছে। মন্তেশ্বরের মালডাঙা, বামুনিয়া-সহ বিভিন্ন গ্রামে আরজি পার্টি তৈরি করা হয়েছে।
মন্দিরে চুরির কিনারা করতে পুলিশ বেশির ভাগ সময়ে ব্যর্থ হচ্ছে কেন? এক পুলিশকর্তার দাবি, “এই ধরনের ঘটনায় ছিঁচকে চোরেদের হাত কম থাকে। বেশির ভাগ সময়ে পাকা মাথা কাজ করে, যারা মন্দিরে চুরির ব্যাপারে দক্ষ। তাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক পাচার চক্রের যোগ থাকাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। এ ছাড়া পরিবারের সদস্যরোও অনেক সময়ে জড়িয়ে পড়েন। সে জন্য পুলিশ চটজলদি কিনারা করতে পারে না।” |