দুটি দেশের সম্পর্ক কি কেবলই রাজনীতি এবং কূটনীতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়? অর্থাৎ রাজনীতি/কূটনীতি যদি দুটি দেশের মধ্যে কাঁটাতারের কাঁটা বাড়াইয়া যায়, সেখানে সমাজ, অর্থনীতি, সংস্কৃতি কি কোনও সংশোধনী ভূমিকা পালন করিতে পারে? ভারত ও পাকিস্তানের প্রসঙ্গে প্রশ্নটি তুলিয়া গেলেন পাক রাষ্ট্রদূত সলমন বশির। স্বল্প সময়ের জন্য রাজ্য সফরে আসিয়া একাধিক বার তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করিলেন দুই দেশের মধ্যে ‘নরম কূটনীতি’র পরিসর বৃদ্ধির দিকে, যাহাতে সেই বিকল্প পরিসর দুই দেশের নাগরিকদের মধ্যে সৌহার্দ্য সঞ্চার করিতে পারে, দীর্ঘমেয়াদি সংকটের মধ্যেও কিছু যোগাযোগসূত্র তৈরি করিতে পারে। বিষয়টি গুরুতর। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে কোনও আশু মীমাংসার সম্ভাবনা নাই, সন্ত্রাস হইতে কোনও দিকেই রেহাই নাই, দুই রাজধানীতেই প্রতিবেশী দেশ সম্পর্কে সংবেদনশীলতা বিপজ্জনক ভাবে অতিরিক্ত। রাজনীতির গতিপ্রকৃতি দুই দেশেই দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উত্তাপ বাড়াইতে ব্যস্ত। নূতন নির্বাচন কিংবা নূতন সরকার গঠনের মুহূর্তে নিয়মমাফিক আশাবাদিতার উচ্চারণের পর অচিরেই আশার বেলুন সশব্দে ফাটিয়া যায়, পড়িয়া থাকে অনাস্থা ও অপরিণামদর্শিতার চিরপুরাতন গোলকধাঁধা। তাই রাজনীতি হইতে পিছু হটিয়া সমাজ, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির স্তরে কী ভাবে সম্পর্কের বুনন সম্ভব, ভাবা দরকার। রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য অতি সংগত।
বহির্দেশের প্রতি ‘ব্যবহার’-এর ক্ষেত্রে সার্বভৌম দেশের হাতে যে কূটনীতি ও সমরাস্ত্র ভিন্ন অন্যতর ‘শক্তি’ও থাকে, ইহা নূতন কথা নহে। নব্বই-এর দশক হইতে এই তত্ত্ব শোনা যাইতেছে, জোসেফ নাই-এর বই ‘সফট পাওয়ার’ (২০০৪) কূটনীতি-মহলে যথেষ্ট আলোড়ন তুলিয়াছিল। সমাজ-অর্থনীতি ও সংস্কৃতির নানা সূত্র ব্যবহার করিয়া কী ভাবে অরাজনৈতিক কিংবা রাজনীতি-নিরপেক্ষ পরিসরের মাধ্যমে দ্বিপাক্ষিক বা বহুপাক্ষিক আন্তর্জাতিক সম্পর্কে পরিবর্তন ঘটানো সম্ভব, তিনি আলোচনা করিয়াছিলেন। সন্দেহ নাই, ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষেত্রে ইহা সমূহ প্রাসঙ্গিক। কেবল দুই দেশের রাজনীতির সংকীর্ণতার জন্যই নহে, দুই দেশের মধ্যে প্রচ্ছন্ন সামাজিক সংযোগের অসামান্য ভাণ্ডারের কারণেও বটে। সাহিত্য-সঙ্গীত-শিল্প-ক্রীড়া-ব্যবসায়-বাজার, এমন ক্ষেত্র নাই যেখানে দুই দেশ পরস্পর হইতে প্রকৃত অর্থে বিচ্ছিন্ন। সাম্প্রতিক অতীতে সেই পরিসরকে বাড়াইবার চেষ্টা বিক্ষিপ্ত ভাবে হইয়াছে, কিন্তু তাহা বিক্ষিপ্তই থাকিয়াছে, আস্থাবাচক হয় নাই। সীমান্ত পারাপারী বাস বন্ধ হইয়াছে, সংস্কৃতিসভায় আসিতে প্রতিবেশী দেশের অংশগ্রহণকারীরা ভিসা পাইতে নাকালের একশেষ হইয়াছেন, সংযোগের বদলে অভিযোগের পারদ চড়িয়াছে। রাজনীতির পাশ কাটাইয়া এই প্রত্যাশিত সামাজিক চলাচলে যে পশ্চিমবঙ্গ বা অন্যান্য রাজ্যেরও বিশেষ ভূমিকা পালন করিবার কথা, সন্দেহ নাই। রাজধানীয় রাজনীতির মুখাপেক্ষী না হইয়া প্রাদেশিক সংযোগ-রেখাগুলি আরও মজবুত করা যায় না কি? রাষ্ট্রদূত যে ‘বার্তা’ দিয়া গেলেন, নিশ্চয়ই তাহা তাঁহার ব্যক্তিগত অভিমত নহে, ইসলামাবাদের মত-ও বটে। ইহা নূতন ব্যাপার নহে। ইসলামাবাদের নানা রাজনৈতিক বাধ্যতা সত্ত্বেও তাহারাই কিন্তু এই অ-সরকারি সংযোগের গুরুত্বের দিকে বার বার ইঙ্গিত করিয়াছে। ভারতই বরং উষ্ণ প্রত্যুত্তর দেয় নাই। আজও ভারতে আগমনেচ্ছু পাক নাগরিককে উচ্চ সরকারি দস্তখত-সংবলিত ‘স্পনসরার’-এর মুখাপেক্ষী হইতে হয়, বিপরীতে ভারতীয় নাগরিকের জন্য পাকিস্তানে এমন নিয়মনিগড় নাই। আকারে ছোটখাটো কিন্তু প্রকারে অসম্মানজনক রীতিগুলি না ঘুচিলে সুসম্পর্কের সূচনা কি কেবল কূটনৈতিক বৈঠকের রুদ্ধদ্বারেই প্রত্যাশিত? ভাবিয়া দেখুক নয়াদিল্লি। ইসলামাবাদও। |