শীতের পরশ গায়ে লাগতেই জেলায় জেলায় বইমেলার ধুম পড়ে যায়। মেলায় যেমন সাধারণ মানুষ বই কেনেন, তেমনি সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারগুলির জন্য বই কেনার ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা করে সরকার। কিন্তু যাদের জন্য গ্রন্থাগারগুলিতে বই কিনে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়, সেই পড়ুয়া বা পাঠকদের জন্য কিন্তু বিভিন্ন গ্রন্থাগার সপ্তাহের বেশিরভাগ দিন খোলা থাকছে না। কারণ, ওই সমস্ত গ্রন্থাগারগুলি দেখভাল করার জন্য গ্রন্থাগারিক থেকে চতুর্থ শ্রেণির কর্মী পদ শূন্য রয়েছে।
দীর্ঘদিন ধরে ওই পদগুলিতে নিয়োগ হয়নি। পরে গ্রামীণ গ্রন্থাগারগুলিতে যেখানে একজন গ্রন্থাগারিক এবং গ্রন্থাগার সহায়ক থাকার কথা, সেখানে কোথাও একজন গ্রন্থাগারিক আছেন। কোথাও একজন সহায়ক রয়েছেন। আবার কোথাও কোথাও গ্রন্থাগারিক বা সহায়ক না থাকায় পরিষেবা পুরোপুরি বন্ধ। এই অবস্থায় কার্যত রাজ্যের বিভিন্ন জেলার গ্রন্থাগার পরিষেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ পাঠক থেকে বই প্রেমীরা। রাজ্যের গ্রন্থাগারগুলির পরিকাঠামো এবং পরিষেবাগত মানোন্নয়নের জন্য রাজা রামমোহন রায় লাইব্রেরি ফাউন্ডেশন নামে একটি সংস্থা কেন্দ্র এবং রাজ্য সরকারের আর্থিক সহযোগিতায় এ রাজ্যে কাজ করে আসছে। ওই সংস্থা সূত্রে এবং স্টেট লাইব্রেরি কাউন্সিল সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, রাজ্যের ২,৪৭৪টি সরকারি অনুমোদনপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারগুলির মধ্যে গত ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত গ্রন্থাগারিক এবং চতুর্থ শ্রেণির পদ নিয়ে মোট ৫৫২০টির মধ্যে ১৯১১ পদ শূণ্য আছে। তা ২০০০ ছাড়িয়ে যাবে বলে দাবি করেছেন, তৃণমূল প্রভাবিত বঙ্গীয় সাধারণ গ্রন্থাগার ও কর্মী কল্যাণ সমিতির রাজ্য সাধারণ সম্পাদক রফিক শেখ। |
বন্ধ হয়ে রয়েছে গ্রন্থাগার। —নিজস্ব চিত্র। |
তিনি জানান, রাজ্যে জেলা গ্রন্থাগার, মহকুমা গ্রন্থাগার বা টাউন লাইব্রেরি এবং গ্রামীণ গ্রন্থাগারগুলি সরকার অনুমোদিত। জেলা গ্রন্থাগারগুলিতে এক জন গ্রন্থাগারিক, দু’জন সহকারী গ্রন্থগারিক, দু’জন গ্রন্থাগার সহায়ক, দু’জন পিওন এবং এক জন নাইটগার্ড নিয়ে মোট ৮টি পদ আছে। মহকুমা গ্রন্থাগার বা টাউন লাইব্রেরিগুলিতে একজন লাইব্রেরিয়ান, একজন সহকারী লাইব্রেরিয়ান-সহ কয়েকজন কর্মী থাকার কথা। গ্রামীণ গ্রন্থাগারগুলিতে একজন গ্রন্থাগারিক, একজন গ্রন্থাগার সহায়ক থাকার কথা। তাঁর দাবি, “বিগত সরকারের আমল থেকে প্রচুর শূন্য পদে লোক নিয়োগ না হওয়ায় বর্তমান সরকারের উপর সেই দায় এসে পড়েছে। তবুও এই সরকার সাধ্যমতো শূন্যপদ পূরণের চেষ্টা করছে।”
তবে কর্মীর অভাবে বীরভূমে নলহাটি থানার কুরুমগ্রাম সম্মিলনী রুর্যাল লাইব্রেরির একজন গ্রন্থাগার সহায়ককে ওই থানার পাইকপাড়া গ্রামীণ গ্রন্থাগারে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এর ফলে ২৫ কিলোমিটার দূর থেকে ওই কর্মীকে ওই গ্রন্থাগারের দায়িত্ব সামাল দিতে হচ্ছে। স্বাভাবিক ভাবে পরিষেবা বিঘ্নিত হচ্ছে। এরকম ভাবে জেলার নানুর থানার উচকরণ গ্রামীণ গ্রন্থাগারে গ্রন্থাগারিক পদে বোলপুর থানার সিঙ্গি গ্রামীণ গ্রন্থাগারিকের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আবার লাভপুর থানার বিপ্রটিকুরি গ্রামীণ গ্রন্থাগাররের গ্রন্থাগারিককে বোলপুর থানার সর্পলেহনা আলবাঁধা গ্রামীণ গ্রন্থাগারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। ময়ূরেশ্বর থানার নওয়াপাড়া গ্রামীণ গ্রন্থাগারের গ্রন্থাগারিককে ষাটপলশা গ্রামীণ গ্রন্থাগারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। অন্য দিকে, সিউড়ির হুকমাপুর আঞ্চলিক গ্রামীণ গ্রন্থাগার কর্মী অভাবে খুলছে না। সিঊড়ি ১ ব্লকের খটঙ্গা পঞ্চায়েত ভবন লাগোয়া গ্রন্থাগারটিতে লাগোয়া ঝাড়খণ্ডের পাঠকেরা ওই গ্রন্থাগারে বই পড়তে আসতেন এবং প্রাক্তন গ্রন্থাগার মন্ত্রী তপন রায় ওই গ্রন্থাগারের উদ্বোধন করেছিলেন।
এ দিকে, জেলার গ্রন্থাগার কর্মীদের খেয়াল খুশি মতো বদলি করে দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বামপন্থী গ্রন্থাগার কর্মী সংগঠনের বীরভূম জেলা সভাপতি অমল সরকার। তিনি বলেন, “আশির দশকে যে সমস্ত কর্মী চাকরি পেয়েছিলেন, তাঁরা প্রতি বছরে অবসর নিচ্ছেন। তার ফলে ২০১৪ সালের মধ্যে বেশির ভাগ গ্রন্থাগারে কর্মী শূন্য হয়ে যাবে। আগামী দিনে গ্রন্থাগারগুলি থেকে পরিষেবা দেওয়া বন্ধ হয়ে যাবে।” তার দাবি, ২০১০-১১ সালের পর বিভিন্ন পদে কর্মী নিয়োগ হয়নি। বীরভূমের ভারপ্রাপ্ত গ্রন্থাগারিক সুমন্ত বন্দোপাধ্যায় (তিনি বর্ধমান জেলা গ্রন্থগারিক পদেও রয়েছেন) বলেন, “বর্ধমান ও বীরভূম দুই জেলাতেই বেশ কিছু গ্রন্থাগারে গ্রন্থাগারিক এবং কর্মী নেই। সেখানে একজন করে কর্মীকে দু’তিন দিনের জন্য ডেপুটেশনে পাঠিয়ে পরিষেবা চালু রাখতে হয়েছে।” তৃণমূল বিধায়ক তথা রাজ্যের উচ্চশিক্ষা এবং কারিগরি শিক্ষার বিধানসভার পরিষদীয় সচিব আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় জেলার গ্রন্থাগার কমিটির সদস্য। তিনি বলেন, “জেলার গ্রন্থাগারগুলিতে কর্মীদের শূণ্যপদ ৩৪ বছরের বাম আমলের ফসল। ধীরে ধীরে ওই পদগুলিতে নিয়োগে উদ্যোগী রয়েছে রাজ্য সরকার। সেখানে কোনও কর্মী নেই সেখানে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কর্মী নিয়োগ করা হবে।”
|