|
|
|
|
বর্ষশেষের ছুটিতে পর্যটকের ঢল অরণ্য-শহরে |
কিংশুক গুপ্ত • ঝাড়গ্রাম |
তিন বছর আগে মাত্র ২৬। মাওবাদী নেতা কিষেণজির মৃত্যুর বছর, ২০১১-য় ১৩৮। গতবার বছর ফুরনোর সপ্তাহে হাজার দেড়েকের বেশি। কিন্তু পর্যটন শিল্পের হিসেবে ২০১৩-র শেষ সপ্তাহে হাজার তিনেকেরও বেশি পর্যটকের ভিড় হয়েছে ঝাড়গ্রামে। ‘ঠাঁই নাই’ অবস্থা অরণ্য-শহরের সব হোটেল-লজে, বলছেন মালিকেরাই। এলাকায় মাওবাদী তৎপরতা কমাতেই এই ‘পরিবর্তন’, বিশ্বাস তাঁদের।
সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বহু মানুষ যুদ্ধের আতঙ্কে কলকাতা ছেড়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের লালমাটির শহর ঝাড়গ্রামে চলে আসেন। তার পর থেকে স্বাস্থ্যকর জলবায়ু আর শাল জঙ্গলে ঘেরা নিসর্গের জন্য বাঙালির কাছে ছুটি কাটানোর আদর্শ জায়গা হয়ে ওঠে ঝাড়গ্রাম। কিন্তু ২০০৪ সাল থেকে মাওবাদী নাশকতা শুরু হয়। ওই বছরের ডিসেম্বরে বেলপাহাড়ির কাঁকড়াঝোরে ল্যান্ডমাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দু’টি বন-বাংলো ধ্বংস করে দেয় মাওবাদীরা। তার পর থেকে পর্যটকদের সংখ্যা ক্রমশ কমেছে। ২০০৮-এর নভেম্বর থেকে জনগণের কমিটির অবরোধ-আন্দোলন এবং মাওবাদীদের লাগাতার খুন-সন্ত্রাসের কারণে কার্যত পর্যটক-শূন্য ঝাড়গ্রামের বেশ কয়েকটি অতিথিশালা ও হোটেলের ঝাঁপ বন্ধ হয়ে যায়। ‘ঝাড়গ্রাম হোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর সাধারণ সম্পাদক মধুসূদন কর্মকারের বক্তব্য, “মাওবাদীদের বাড়বাড়ন্তের সময় কী ভাবে ব্যবসা চলবে সে ভাবনায় দিন গিয়েছে। আর এখন ঝাড়গ্রাম শহর এবং আশপাশ মিলিয়ে যে গোটা ২০ হোটেল রয়েছে, তার কোথাও ঘর ফাঁকা নেই। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আরও এক হাজার পর্যটক অগ্রিম বুকিং করেছেন।” তাঁর দাবি, “এ বার বর্ষশেষে শহরে আসা পর্যটকের সংখ্যাটা ৩০০০ ছাড়িয়ে গিয়েছে।”
রাজ্যে ক্ষমতার পালাবদলের পরে ঝাড়গ্রাম তথা লাগোয়া জঙ্গলমহলের পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। ২০১১-র ২৪ নভেম্বর মাওবাদী শীর্ষনেতা কিষেণজির মৃত্যু এবং তার পরে পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনীর তল্লাশি, অভিযানের ফলে মাওবাদীরা কার্যত কোণঠাসা হয়ে পড়ে এলাকায়। এলাকা শান্ত হওয়ার খবর পৌঁছতেই আসতে শুরু করেন পর্যটকেরা।
ঝাড়গ্রামের ‘অরণ্যসুন্দরী’ অতিথিশালার মালিক শিবাশিস চট্টোপাধ্যায় বলেন, “যাঁরা স্পট-বুকিংয়ের জন্য আসছেন, তাঁদের ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছি।” ঝাড়গ্রামের বাঁদরভুলায় রাজ্য বন উন্নয়ন নিগমের প্রকৃতি পর্যটন কেন্দ্রে কেবলমাত্র ‘স্পট বুকিং’ হচ্ছিল। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আসন্ন জঙ্গলমহল সফরের কথা মাথায় রেখে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে তা-ও। ফলে, অগ্রিম বুকিং না করে যাঁরা ঝাড়গ্রামে আসছেন, তাঁদের কপাল চাপড়াচ্ছেন।
যাদবপুরের বাসিন্দা, তথ্য-প্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত সৌগত মজুমদার যেমন। ভেবেছিলেন, বছরের শেষ সপ্তাহটা ঝাড়গ্রামে কাটাবেন। কিন্তু বুকিং পাননি। তাঁর আক্ষেপ, “জঙ্গলে ঘেরা ঝাড়গ্রাম, কাঁকরাঝোরের কথা গল্পের বই, পত্রপত্রিকায় পড়ে জায়গাগুলো নিয়ে কেমন যেন একটা রোম্যান্টিক ধারণা, তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বন্ধুবান্ধব, বাড়ির লোকদের নিয়ে ঝাড়গ্রামে যাব ভেবেছিলাম। বুকিংই পেলাম না।”
বুকিং যাঁরা পেয়েছেন, তাঁরা রয়েছেন আনন্দে। কেষ্টপুরের পিয়া রায় যেমন বললেন, “এখন তো আর এই এলাকায় আসতে অসুবিধা নেই। আমরা তো রীতিমতো উপভোগ করছি।” প্রায় একই সুর বেলপাহাড়ির জঙ্গল ঘুরে আসা উল্টোডাঙার তথাগত চক্রবর্তী, দমদমের বিজন দাশের মতো পর্যটকদের গলায়। যাঁরা বলছেন, “অশান্তি ছিল বলে আগে এখানে আসা হয়নি। এখন তো সে সমস্যা নেই। তাই ইচ্ছেমতো ঘুরেছি।” ভাড়ার গাড়ির চালক লম্বু মাহাতো, শেখ সাবের আলিরা বলছেন, “এ বার প্রায় প্রতিদিনই বেলপাহাড়ির ঘাঘরা, তারাফেনি ও কাঁকড়াঝোরের দিকে যাওয়ার পার্টি (পর্যটক) পাচ্ছি। অনেক দিন পরে সুদিন ফিরেছে।” তবে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তাঁরা যোগ করছেন, “এমনটাই যেন থাকে।” |
|
|
|
|
|