সাফল্য অবশেষে এল। ভূগর্ভের জলে মিশ্রিত আর্সেনিক বর্জন করতে পারে, এমন ধানের বীজ রাজ্যের কৃষি বিজ্ঞানীরা তৈরি করতে পেরেছেন বলে দাবি করল পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কৃষি দফতর। সরকারের বক্তব্য, কৃষি দফতরের গবেষণাগারে এ ধরনের তিনটি ধান-বীজ তৈরি করা হয়েছে, যার একটা কৃষকদের বিলি করা হবে।
বিশ্বের যেখানেই মাটির নীচের জলে বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিক মিলেছে, পরবর্তী কালে সেখানে উৎপন্ন ধান ও আনাজের মধ্যেও ধরা পড়েছে আর্সেনিকের অস্তিত্ব। ফসলের মারফত তা ঢুকে পড়ছে মানবশরীরে, যা আর্সেনিক-দূষিত জলের মতোই শরীরে বিষক্রিয়া সৃষ্টিতে সক্ষম বলে বিজ্ঞানীদের দাবি। এবং কৃষি-বিজ্ঞানীরা দেখেছেন, ভূগর্ভের জল থেকে সর্বাধিক আর্সেনিক ঢোকে ধানেই।
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গে যে হেতু ধানই প্রধান ফসল, তাই এখানে বিকল্প ধান-বীজ তৈরির জন্য রাষ্ট্রপুঞ্জের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা (ফাও) জোর দিচ্ছে অনেক দিন ধরে। সেই মতো এ রাজ্যে আর্সেনিক প্রতিরোধী ধান উৎপাদনের গবেষণা শুরু হয়, যার ফল এ বার মিলেছে বলে সোমবার কৃষি দফতর আয়োজিত আলোচনাচক্রে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। দফতরের দাবি, চুঁচুড়ার ধান গবেষণাকেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা লখনউয়ের ন্যাশনাল বটানিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যৌথ গবেষণায় আর্সেনিক-নিরাপদ, এবং একই সঙ্গে উচ্চ ফলনশীল ধান-বীজ তৈরি করেছেন।
খাদ্যের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া আর্সেনিকের বিষ কী ভাবে জীবজগৎকে বিপন্ন করছে, বিশেষজ্ঞদের কথায় তার ইঙ্গিত স্পষ্ট। কৃষি বিশেষজ্ঞ তথা বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য সরোজ সান্যালের কথায়, “বহু ক্ষেত্রে সহনসীমার অনেক বেশি আর্সেনিক জমা হচ্ছে ধানের মতো ফসলে। এমনকী, খড়েও। গরু-ছাগল সেই খড় খেলে তাদের দেহেও ঢুকে পড়ছে আর্সেনিক।” আর ওদের দুধ বা মাংস খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে পরোক্ষে ভাবে মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর্সেনিক-বিশেষজ্ঞ দীপঙ্কর চক্রবর্তীর মন্তব্য, “যেখানকার ভূগর্ভস্ত জল আর্সেনিকে দূষিত নয়, সেখানকার বাসিন্দারাও এ ভাবে দূষণের কবলে পড়ছেন।” খাদ্য-শৃঙ্খলে আর্সেনিকের পরিমাণ সহনশীল মাত্রার মধ্যে এনেই পশ্চিমবঙ্গ-বাংলাদেশের ৮০% নাগরিককে আর্সেনিক-দূষণ থেকে মুক্ত করা সম্ভব বলে মনে করেন তিনি।
পশ্চিমবঙ্গের মালদহ, মুর্শিদাবাদ, নদিয়া ও দুই ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ অংশ এবং বর্ধমানের পূর্বস্থলী-১ ও পূর্বস্থলী-২ ব্লকে আর্সেনিকের দূষণমাত্রা যথেষ্ট বেশি। আবার ওখানে ধানের ফলনও বেশি। কাজেই এই সব অঞ্চলে জলের পাশাপাশি খাদ্যবাহিত আর্সেনিক দূষণের আশঙ্কাও প্রবল। এক কৃষি-কর্তা জানাচ্ছেন, মিনিকিট কিংবা শতাব্দী, লাল স্বর্ণ, ললাট, আইআর-৩৬, আইআর-৬৪’র মতো চাষির পছন্দের বিভিন্ন ধান খুব বেশি পরিমাণে আর্সেনিক-দূষণপ্রবণ। আর্সেনিকদুষ্ট এলাকায় সেগুলোর চাষ করলে ধানের দানা ও গাছে বিপুল পরিমাণ আর্সেনিক মিশে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। ফলে মানুষের বিপদের আশঙ্কা প্রভূত। কী রকম?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)-র হিসেবে, ৬০ কেজি ওজনের এক জন মানুষের দেহে দৈনিক ১২৬ মাইক্রোগ্রামের বেশি আর্সেনিক ঢোকা উচিত নয়। এ দিকে রাজ্যের বিভিন্ন আর্সেনিকপ্রবণ এলাকায় উৎপন্ন কিছু চালু জাতের ধানের দানায় প্রতি কেজিতে ১৫০০ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত আর্সেনিক মিলেছে। সাধারণত দু’বার ভাত খেলে মোট চারশো গ্রাম চাল লাগে। সে ক্ষেত্রে ওই ধানের ভাত দু’বার খেলেই শরীরে ঢুকছে ৬০০ মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক!
লখনউ-চুঁচুড়ার বিজ্ঞানীরা আর্সেনিক-রোধী মোট তিন জাতের ধান-বীজ তৈরি করেছেন। এর মধ্যে সিএন-১৭৯৪-২ জাতটির ফলন-হার সর্বাধিক। চুঁচুড়ার ধান গবেষণাকেন্দ্রের বিজ্ঞানী বিজন অধিকারী বলেন, “এটি আমন মরসুমে হেক্টরপিছু সাড়ে চার-পাঁচ টন ফলন দেয়। বোরো মরসুমে সাড়ে পাঁচ-ছ’টন পর্যন্ত। আবার অত্যধিক আর্সেনিকপ্রবণ অঞ্চলে চাষ করে দেখা গিয়েছে, এর প্রতি কেজিতে আর্সেনিক বড়জোর ৩৮ মাইক্রোগ্রাম।” কৃষি দফতরের খবর, এই প্রজাতিটিকেই আগামী মার্চ-এপ্রিলে রাজ্যকে ছাড়পত্র দিতে চলেছে। নতুন ধানের নামকরণ করতে মুখ্যমন্ত্রীকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। “ছাড়পত্র পেলে সরকারি উদ্যোগে ওই ধানের বীজ বানিয়ে কৃষকদের বিলি করা হবে। অন্য রাজ্যে ও বিদেশেও রফতানি করতে উদ্যোগী হব।” জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীর কৃষি-উপদেষ্টা প্রদীপ মজুমদার।
আর্সেনিক-প্রতিরোধী এ হেন ধান-বীজ পশ্চিমবঙ্গ তো বটেই, দেশের অন্য রাজ্য, এমনকী বাংলাদেশ ও নেপালেরও উপকারে আসবে বলে আশা করছেন লখনউয়ের ন্যাশনাল বটানিক্যাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের অধিকর্তা চন্দ্রশেখর নাটিয়াল। নদী-বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রের মতে, সেচের জন্য ভূগর্ভের জল তোলা যখন বন্ধ করা যাচ্ছে না, তখন এই জাতীয় ধানের চাষ আর্সেনিক-বিরোধী যুদ্ধের বিকল্প হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। |