মাঝরাতে খুটখাট আওয়াজে ঘুমটা হঠাৎই চটে গিয়েছিল তাঁর।
শীতের রাত। দরজা-জানলা সব বন্ধ। তবু রোজ রাতেই সতর্ক হয়ে ঘুমোন বছর পঞ্চান্নর সুকুমার সরকার। বিশেষ করে ডাকাতদের সেই চিঠিটা আসার পর থেকে।
আওয়াজটা আসছিল বাইরের গ্রিল থেকে। সন্তর্পণে তাই জানলার পাল্লা ফাঁক করে উঁকি দেন প্রৌঢ় “তখন রাত প্রায় সওয়া ১টা। দেখি, ১০-১২ জনের একটা দল লোহার গ্রিল ভাঙার চেষ্টা করছে। মুখ কাপড়ে ঢাকা। আমি সোজা ছাদে উঠে যাই।”
বসিরহাটের মেরুদণ্ডী গ্রামের মাঝেরপাড়ায় সেই ছাদ দেখলে কে বলবে যে সেটা নিতান্তই ছাপোষা গেরস্থ বাড়ি? পাঁচিলের ধারে সার দিয়ে সাজানো তির-ধনুক, বল্লম, গুলতি আর রেললাইন থেকে কুড়িয়ে আনা পাথর। শুধু কি তাই? পাঁচিলের গা বরাবর পরপর ফুটো, একেবারে দুর্গের মতো।
ডাকাতেরা দিব্যি গ্রিল ভেঙে ঢোকার তোড়জোর করছিল। হঠাৎই উপর থেকে পাথরের টুকরো ছুটে আসতে থাকে। “পাঁচিলের ফাঁক দিয়েই দেখতে পাচ্ছিলাম ওদের। সঙ্গে সঙ্গে তাক করে পাথর ছুড়তে শুরু করি। কিন্তু ওরা পাল্টা গুলি ছোড়ে। তখনই ধনুকটা কুড়িয়ে নিই।” সাঁ করে তির ছুটে আসে। ডাকাতেরা প্রথমে বোঝেনি। সাঁ-সাঁ আরও তিন-চারটে তির হাওয়া কেটে বেরিয়ে যায়। অন্ধকারে বিঁধেও যায় এক জনের গায়ে বাবা গো! গুলি করে মারব কিন্তু...! |
গুলি ছোটেও। কিন্তু কার দিকে? দেখাই তো যাচ্ছে না কাউকে। এ কি মেঘের আড়ালে মেঘনাদ? ভাবতে-ভাবতেই আরও তির, আরও-আরও তির। “উপর থেকেই দেখি, এক জনের পেটের কাছে বিঁধেছে। আর এক জনের পিঠে।”
গুলির শব্দ, হইচইয়ে পাড়াপড়শি জেগে গিয়েছিল। বেগতিক বুঝে ডাকাতেরা বোমা ছোড়ে। তা অবশ্য ছাদ পর্যন্ত পৌঁছয়নি। “লোকে বেরিয়ে আসছে দেখে দু’জনকে কাঁধে করে নিয়ে ডাকাতেরা পালায়” স্বস্তির শ্বাস ছেড়ে মৃদু হাসেন প্রৌঢ়।
সুকুমারবাবু কিন্তু মোটেই মারদাঙ্গা করার লোক নন। বরং চাষবাস করে শান্তিতেই কাটিয়ে দিয়েছেন এতগুলো দিন। বড় ছেলে সেনা, থাকেন সেকেন্দ্রবাদে। ছোট ছেলে দিল্লিতে ফুলের ব্যবসা করেন। অসুস্থ গিন্নিকে সামলে সুকুমারবাবু দিব্যি ছিলেন। কিন্তু গত শীতে বাড়িতে ডাকাত পড়া ইস্তক তিনি পাল্টে গিয়েছেন।
প্রৌঢ় জানান, গত বছর সেই রাতে ছাদে ধান চাপা দেওয়ার পাথর ছিল। তা ছুড়েই তিনি বেশ ডাকাতদের রুখে দেন। পরে পড়শিরা বেরিয়ে আসায় তারা আর সুবিধে করতে পারেনি। কিন্তু পরে খুনের হুমকি দিয়ে চিঠি আসে। সেই চিঠি পুলিশের কাছে জমাও দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু শুধু পুলিশের ভরসায় কি বসে থাকা যায়? তিলে-তিলে তাই নিজের ‘দুর্গ’ও গড়ে তোলেন সুকুমারবাবু। “ভাগ্যিস বাঁশের বাখারি দিয়ে ধনুক আর লোহার ফলা লাগানো তির তৈরি করিয়ে রেখেছিলাম! তাই প্রাণে বেঁচে গেলাম” বলেন প্রৌঢ়। সকালে পুলিশ গিয়ে দেখে, বাড়ির কাছেই চাপ-চাপ রক্ত। দু’টো তাজা বোমাও পায়। পুলিশের অনুমান, অন্তত আট রাউন্ড গুলি চলেছে। ছাদ থেকে ২২টি তির ছোড়া হয়েছিল। তার মধ্যে ১৭টি খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। বাকি পাঁচটি বিঁধে থাকতেপারে। যদিও এসডিপিও (বসিরহাট) অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “কেউ তিরবিদ্ধ হয়েছে, এমন প্রমাণ আমরা এখনও পাইনি।”
এলাকার মানুষ বলছেন, শীত পড়লেই বাংলাদেশ সীমান্ত ঘেঁষা এই এলাকায় দুষ্কৃতীদের আনাগোনা বাড়ে। সুকুমারবাবু খুবই সাহসী। কিন্তু সকলে তো তা নন।
ডাকাত পালিয়েছে। এখন পুলিশ বলছে, ডাকাত ধরার ব্যবস্থা হচ্ছে। |