পুনর্বণ্টন, পুনর্বণ্টন! তোমার বৃদ্ধি নাই? প্রশ্নটি কংগ্রেসের নেতাদের আতান্তরে ফেলিবে হয়তো। অথচ, বৃদ্ধি ছিল, সত্যই ছিল এবং নীতির কেন্দ্রস্থলে ছিল। সাত নম্বর রেসকোর্সের বাসিন্দার কি মনে পড়িবে, তিনি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী রূপে বেসরকারি ক্ষেত্রের জায়গা প্রশস্ত করিয়া আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়াইতে অগ্রণী ভূমিকা লইয়াছিলেন? সেই সরকার কংগ্রেসের প্রচলিত পথ হইতে সরিয়া আসিয়াছিল। কিন্তু, আগের পথটিও, নূতন পথটির ন্যায়, বৃদ্ধিকেন্দ্রিকই ছিল। সেই পথে যাত্রা শুরু হইয়াছিল স্বাধীনতা অর্জনের পূর্বেই, জাতীয় পরিকল্পনা পর্ষদ গঠনের মাধ্যমে। প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন হইয়া জওহরলাল নেহরু যে পথে অবিচলিত ছিলেন, তাহা উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে অর্থনীতিকে অগ্রসর করিবার পথ। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সর্বাঙ্গে সেই আদর্শের প্রমাণ। ইন্দিরা গাঁধী, তাঁহার ‘গরিবি হটাও’-এর স্লোগান সত্ত্বেও, বৃদ্ধির অর্থনৈতিক পথ হইতে বিচ্যুত হন নাই। এই নেহরু-গাঁধী যুগে স্পষ্টতই জোর ছিল রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উপর। জুলাই ১৯৯১-উত্তর নরসিংহ রাও সেই জোরকে বাজারে লইয়া আসেন। কংগ্রেসের নেতৃত্বাধীন ইউপিএ এই বৃদ্ধির পথটি সম্পূর্ণ বিস্মৃত হইল কেন? কেহ সংশয় প্রকাশ করিতে পারেন, ইতালি তথা পশ্চিম ইউরোপের বৃদ্ধি-বিরোধী পুনর্বণ্টনের অর্থনীতির ধারণাটি সনিয়া গাঁধী হয়তো অবচেতনেই বহন করিয়া চলিতেছেন। তাহার দায় কংগ্রেস তথা ভারতকে বহন করিতে হইতেছে।
বোঝাটি বড় অসহ হইল। ২০১৩ সালের দ্ব্যর্থহীন বার্তা বৃদ্ধির কথা ভুলিলে অর্থনীতি প্রত্যাঘাত করিবেই। কংগ্রেস এখন সেই ধাক্কায় বেসামাল। ভারতও। বুশসাহেবও ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ বলিয়া এই দায় ঝাড়িয়া ফেলিতে পারিতেন না। গত পাঁচ বৎসরে কংগ্রেসের মুখে আর্থিক বৃদ্ধির কথা শোনাই যায় নাই নেতারা ‘সর্বজনীন বৃদ্ধি’র মালা জপিতেই ব্যস্ত ছিলেন। সর্বজনকে বৃদ্ধির শরিক করিতে চাওয়া অতি মহৎ, সন্দেহ নাই, কিন্তু গোড়ায় বৃদ্ধি না থাকিলে তাহার শরিক করা আর না-করায় কী-ই বা যায় আসে! একুশ শতকে যে ভারত বিশ্বশক্তি হইবার দাবি পেশ করিত, তাহার মূল জোর ছিল আর্থিক বৃদ্ধিতে। দুর্ভাগ্য, স্বয়ং মনমোহন সিংহ সেই জোর কাড়িয়া লইলেন। অবশ্য, এই সিদ্ধান্তটি তাঁহার, অথবা কোনও সিদ্ধান্তই তাঁহার, এমন দাবি করিলে অন্যায় হইবে। যাঁহারা বৃদ্ধিকে ‘যথেষ্ট’ জ্ঞান করেন না, তাঁহারা বণ্টনের প্রশ্নে জোর দেন, তাঁহারা কি খেয়াল করেন নাই যে বৃদ্ধির নটেগাছটি সম্পূর্ণ মুড়াইয়া গিয়াছে? কী ভাবে ঘুরিয়া দাঁড়ানো সম্ভব, সে বিষয়ে একটিও কথা তো তাঁহাদের মুখে শোনা যায় নাই। ভারত যে ফের নখদন্তহীন হইবার মুখে, তাহার দায় এই নেতারা এবং তাত্ত্বিকরা অস্বীকার করিবেন কী উপায়ে? এই বৎসরটি অর্থনীতির পক্ষে একেবারেই অন্ধকার কাটিল। তবে, আলোর দুইটি রেখা একটি প্রকট এবং অন্যটি ক্ষীণ দৃশ্যমান। প্রথমটি নরেন্দ্র মোদীর উত্থান। বৃদ্ধির অর্থনীতিতে তাঁহার বিশ্বাস প্রশ্নাতীত। সাধারণ মানুষের মধ্যে তাঁহার গ্রহণযোগ্যতা এবং সমর্থকের সংখ্যা যে ভাবে বাড়িয়াছে, তাহাতে বৃদ্ধির পথে ফিরিতে দেশবাসীর আকুলতাও স্পষ্ট। সম্ভবত এই আকুলতা দেখিয়া, এবং বৃদ্ধির পরিপন্থী নীতির অসারতা অনুধাবন করিয়া কংগ্রেসের মধ্যেও কিছু পরিবর্তন আসিতেছে। রাহুল গাঁধী অতি সম্প্রতি একাধিক উপলক্ষে আর্থিক বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তার কথা বলিয়াছেন। অতি ক্ষীণ, কিন্তু ইতিবাচক একটি ইঙ্গিত। বহু বিলম্বে হইলেও হয়তো কংগ্রেসের ঘুম ভাঙিতেছে। ২০১৪ হইতে ভারত ফের বৃদ্ধির পথে চলুক। পুনর্বণ্টন হউক, সর্বজনীন উন্নতি হউক, অসাম্য কমুক, সকলই কাম্য, কিন্তু কোনওটিই বৃদ্ধির মূল্যে নহে। বিদায়ী বৎসর শিখাইয়া গেল, আর্থিক বৃদ্ধিতে বাধা পড়িলে আর কিছুরই কোনও অর্থ থাকে না। আগ্মার্কা সদিচ্ছারও নহে। |