|
|
|
|
|
|
|
তুই তুমি আপনি |
রিকশাওয়ালা ‘তুমি’, ট্যাক্সিওয়ালা ‘আপনি’। চার্লস শোভরাজ ‘তিনি’, ছিঁচকে চোর ‘সে’।
প্রেমের আগে ‘তুই’, প্রোপোজ করেই ‘তুমি’। লিখছেন সুস্নাত চৌধুরী।
|
ভিখিরিকে কখনও ‘আপনি’ বলে ডেকেছেন? রিকশাওয়ালা, তা তিনি বাপের বয়সি হলেও রিফ্লেক্স আপনাকে ‘আপনি’ বলা থেকে আটকেছে। আপনি তেমন মাতব্বর টাইপ্স হলে, তুইতোকারি করেছেন হেলায়, রেলায়: ‘কী রে, কে যাবি রে?’ খুব সমাজ সচেতন হলে বলেছেন— ‘এ নাও গো, ছেলের চিকিচ্ছে করিও’ কিংবা ‘আচ্ছা বাবা, তোমায় পাঁচ টাকা বেশি ভাড়াই দেব, একটু জোরে টানো এ বার।’ অথচ ওই অশিক্ষিত ছোটলোক ভিখিরি কি রিকশাওয়ালারা কিন্তু আগাগোড়া আপনাকে ‘আপনি’ই বলে এসেছেন— আপনি কেরানি না প্রোমোটার, অধ্যাপক না আন্ডার গ্র্যাজুয়েট বিচার করেননি।
আপনার আদরের লাল টুকটুকে নতুন গাড়িটিকে যখন ১৫ দিনের মাথায় হালকা ঘষে দিয়েছে বেআক্কেলে রিকশা, অন্তর থেকে খুব থাপ্পড় পেলেও আপনি নিজেকে আটকেছেন। কিন্তু চিৎকার করতে দ্বিধা করেননি— ‘অ্যাই, দেখে চালাতে পারিস না!’ আবার মাস খানেকের মাথায় যখন ছোট্ট চুমু খেয়েছে রংচটা হলুদ ট্যাক্সি, আপনি একই ভাবে চেঁচিয়ে উঠেছেন, একই অভিব্যক্তি ছিল, শুধু ‘তুই’টা বদলে গিয়েছিল ‘তুমি’-তে— ‘আরে ভাই, দেখে চালাও!’ আর যখন টোকাটা মারল আপনার চেয়ে আরও লাখ দুয়েক বেশি দামের একটা সেডান, আপনি তখনও রাস্তা-টাস্তা আটকে ক্যাচাল বাধিয়েছেন, কিন্তু, আপনি-র নীচে নামেননি— ‘দ্যোর মশাই, দেখে চালাতে পারেন না!’ |
|
ব্যক্তিভেদে আর্থ-সামাজিক অবস্থানের ফারাক যে এ ভাবে আমাদের থেকে সম্বোধনের তারতম্য আদায় করে নেয়, তাকে আমাদের ‘শিক্ষা’ বা ‘সংস্কৃতি’ না বলে ‘রিফ্লেক্স’ বলাই বোধহয় ঠিক। সন্ধের মহানগরে বেকার টাইম খেতে থাকা বাসটিতে সওয়ার হয়ে যখন বিরক্ত হয়ে ওঠেন অফিস-ফেরতা সুশিক্ষিত ভদ্র যুবকটি, তিনিও তো দুমদুম চাপড় মেরে চল্লিশোর্ধ্ব ড্রাইভার আর কন্ডাক্টরকে উদ্দেশ্য করে হেঁকে ওঠেন— ‘টান না রে ভাই, আর কত প্যাসেঞ্জার তুলবি?’ এক বাস মানুষের কারও মনেই কি তখন প্রশ্ন জাগে, যে, ক্রিয়াপদগুলি ‘টানুন’ কিংবা ‘তুলবেন’ হলে বাসটা একটু জোরে চললেও চলতে পারত? অবশ্য, চরম মোহনবাগান সমর্থকটি যখন উত্তেজিত হয়ে কাৎসুমির উদ্দেশে বলেন ‘চল্, চল্, বলটা বাড়া এ বার...’, কিংবা, টেনশনে ভরা স্লগ ওভারে যখন ক্লাস সিক্সের ছোঁড়াটিও টিভির পরদায় ধোনির দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে ওঠে, ‘আরে এটা মারতে পারলি না...’— তখন সেখানে অপমানের ছিটেফোঁটাও থাকে না। যেমন থাকে না, ‘চল্ রে চল্ সবে ভারতসন্তান’ গাইবার সময়। ‘চলুন’ বা ‘চলো’ বললে, গানটি মাঠে মারা যায়। মঞ্চে তো মারা যায়ই!
কিন্তু, দিন বদলের স্বপ্ন দেখা তরুণ নেতাটি যখন ঢুকে যান গ্রামবাংলার ধানখেত পেরিয়ে, চাষিভাইদের একজোট করে বপন করতে থাকেন তাঁর সৎ রাজনৈতিক বিশ্বাসের বীজ— কেমন বক্তৃতা করেন তখন? ‘এই জমি তোমাদের, এক চিলতে মাটিও তোমরা ছাড়বে না...।’ না হয় তাঁরা মার্ক্স-এঙ্গেলস-মাও পড়েননি, চাষাভুষো খেটে খাওয়া মানুষ— তাই বলে ষাটোর্ধ্ব-সত্তরোর্ধ্ব মানুষগুলোর বরাতে কখনও ‘আপনি’ জুটবে না? এক কালে রক্তচোষা জমিদার তাঁদের ‘তুই’ বলে এসেছেন, পরে সত্যি সত্যিই পাশে দাঁড়ানো বাবুরাও তাঁদের গড়পড়তা তুমি-র ওপরে জায়গা দিতে পারলেন না।
কাকে ‘তুই’ বলতে হবে, কাকে ‘তুমি’ বা ‘আপনি’— তা নির্ধারণ করতে একটা বড় ফ্যাক্টর: বয়স। কলেজ-লাইফে অচেনা লোকে তুমি-তুমি বলত। তাতে আঁতে লাগলে, ‘কাল ছিল গাল খালি, আজ চুলে যায় ভরে!’ ছেলেদের দাড়ি, মেয়েদের শাড়ি— আনজান পাবলিকের থেকে বহু-আকাঙ্ক্ষিত ‘আপনি’ আদায় করে নিত! নইলে মনে হত, আমি তো তাঁদের আপনি-আজ্ঞে করছি, কিন্তু জাস্ট কয়েক বছর আগে ঘটনাচক্রে জন্মে গিয়েছে বলে অচেনা-আধাচেনা কিছু মানুষ নির্দ্বিধায় তুইতোকারি করে যাবে? মাগনা! কখনও কি সবারই এই রোখ চেপে যায় না— রাস্তাঘাটে যে আমায় তুই বলবে, আমিও তাকে তুই বলব! সত্যজিৎ রায়ের তারিণীখুড়োর একটা গল্পে গেরুয়াধারী সন্ন্যাসী তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘কী চাস তুই?’ এই প্রশ্নে খেপে যান খুড়ো— ‘বাবাজিদের এই হোলসেল তুইতোকারির ব্যাপারটা আমি মোটে বরদাস্ত করতে পারি না। তাই এঁর প্রশ্ন শুনে ধাঁ করে মাথায় রক্ত উঠে গেল।’
উপেন্দ্রকিশোরের ‘উকুনে বুড়ির কথা’ চমৎকার এক উদাহরণ। সেখানে শুরু থেকেই সকলের সঙ্গে সকলের— বুড়ি-বক, বক-নদী, নদী-হাতি, হাতি-গাছ, গাছ-ঘুঘু... সব সম্পর্কই তুইতোকারির। কিন্তু ঘুঘু যেই রাখালের সঙ্গে কথা বলছে, তাকে ‘তুমি’ বলছে। উলটো দিকে রাখাল কিন্তু বলছে ‘তুই’। আবার রাজার বাড়ির দাসী রাখালকে বলছে ‘তুই’, রাখাল তাকে বলছে ‘তুমি’। গোটা গল্পে ‘আপনি’ সম্বোধন জুটছে কেবল রানিমা আর রাজামশাই-এর।
বাংলা খবরের কাগজ বা নিউজ চ্যানেলের ভয়েস ওভারে ছোটখাটো চোর-ছ্যাঁচড়দের ক্ষেত্রে তুচ্ছার্থে ‘সে’, ‘তাকে’ ব্যবহৃত হয়। কিন্তু অপরাধী যেই চার্লস শোভরাজ, বিন লাদেন বা দাউদ ইব্রাহিম, তখন বলা হয় ‘তিনি’, স-চন্দ্রবিন্দু ‘তাঁআঁকে’! মানে, একটি চুনোপুঁটির চেয়ে অনেক অনেক বেশি ঘৃণ্য ও মারাত্মক অপরাধে যিনি দোষী, তাঁর জন্য বরাদ্দ বেশ খানিক সম্মান!
আগে থেকেই ধরে নিয়ে সম্বোধনের ফ্যালাসি আরও আছে। ১৩৪০ সনের শ্রাবণ সংখ্যার ‘বিচিত্রা’-তে এই বিষয়টি নিয়েই একটি বিতর্ক চলে। ব্যক্তির পোশাক-আশাকের উপর কী ভাবে সম্বোধন নির্ভর করে, তা বোঝাতে শুরুতেই এক গভীর গোলমালের কথা ফাঁদেন সম্পাদক উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়। ‘বৈঠকখানার কাজ করতে করতে হঠাৎ তাকিয়ে দেখি দরজার কাছে এক ব্যক্তি দাঁড়িয়ে— পরিধানে পরিচ্ছন্ন ধুতি, দেহে সদ্য-ধৌত ছিটের সার্ট, পায়ে কালো রঙের বার্ণিশ করা পাম্প্ শু এবং মাথায় হাল ফ্যাশনে ছাঁটা বারো-আনা চার-আনা চুলের মধ্যে সযত্ন-রচিত টেরি। ব্যস্ত হয়ে বলি, “ওখানে দাঁড়িয়ে কেন? ভিতরে আসুন?” অপরিচিত ব্যক্তির মুখে বিহ্বলতার গ্লানি ফুটে ওঠে, কুণ্ঠিত স্বরে সে বলে, “আজ্ঞে আপনাদের চাকর রাস্তা থেকে আমাকে পাঠিয়ে দিলে। কে চুল ছাঁটবেন।” ‘আপনি শব্দের অপপ্রয়োগে বিরক্ত হয়ে উঠি। নাপিতের ক্ষৌর দ্রব্যের বাক্সটি দৃষ্টি-গোচর না হওয়াতেই এই দুর্ঘটনা!’ ‘দুর্ঘটনা’টি আপাত মজার, কিন্তু অনেক জরুরি প্রশ্ন: পরামানিককে ‘আপনি’ বলাটা অপপ্রয়োগ হতে যাবে কেন?
ধাঁধা আরও আছে। ‘আপনি’, ‘তুমি’ না ‘তুই’ কোনটা কাছের কোনটা দূরের? আজ থেকে আধা শতক আগেও তো বাবাকে ‘আপনি’ বলার রেওয়াজ ছিল। মা-কে ‘তুই’ বলত অনেকেই। এই ‘আপনি-বাবারা’ কম শ্রদ্ধা-ভালবাসার লোক ছিলেন, না ‘তুই-মা’রা কম শ্রদ্ধার ভালবাসার লোক ছিলেন? স্বামীকেও সে সময় ‘আপনি’ বলাই ছিল স্ত্রীদের রীতি। তখন কি তবে স্বামী কাছের মানুষ ছিলেন না? এ সবের ব্যাখ্যা তুই-তুমি-আপনির কনভেনশন চট করে দিতে পারে না।
আবার নৈকট্য কখনও আপনি-কে তুই-এও এনে ফেলে। শ্যামাসংগীত। ‘তোরে ডাকার মতো ডাকতে যদি পারি, তবে আসবি নে তোর এমন সাধ্য নেই’। ‘তুই নাকি মা দয়াময়ী, শুনেছি ওই লোকের মুখে’। কিন্তু, নৈকট্য গভীর গভীরতর হলে এই তুই-ই আবার বদলে যায় তুমি-তে! ফার্স্ট ইয়ার সেকেন্ড ইয়ার দিব্যি তুইতোকারি চলল, ওয়ান ফাইন মর্নিং হয়ে গেল তুমি! বোঝো, প্রোপোজ করার পর ক্ষণ থেকেই তুমি-তুমি বললে নাকি শরীর জুড়ে অলৌকিক শিহরন! আসলে ওই মুহূর্ত থেকে তো আর বন্ধু নয়, তারা চলে দেছে ‘স্বামী-স্ত্রী’ মোড-এ! আর বিয়ের পরেও তুইতোকারি চললে তো আর রক্ষে নেই। আত্মীয়-পড়শিদের গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুরে টেকা দায়!
অথচ জীবনের খেলা এমন বিচিত্র— যখন কোথাও আর কেউ নেই, শুধু আবেগ আর প্রবৃত্তি আছে, তখন বহু ক্ষেত্রেই দাম্পত্য সম্পর্কের এ সব সম্বোধন আপনা-আপনিই বদলে যায়। বন্ধুবান্ধবের ‘ওই সব’ গল্প থেকে বুঝেছি, এমনিতে যাদের তুমি-র সম্পর্ক, সেই সব ঘন সময়ে, ঘামঝরা মুহূর্তে অনেকেই পরস্পরকে ‘তুই’ বলে। এতে হরমোন তীব্রতর হয়!
কাজেই, দুটো মানুষের নৈকট্য বা দুটো মানুষের দূরত্বের গায়ে প্রথামাফিক একটা করে সর্বনামের টিকিট আটকে আলাদা-আলাদা খাপে পুরে রাখা যায় না। তবু আমরা সেই চেষ্টাই চালিয়ে যাই। নিয়ম আঁকড়ে থাকি। সে ডাকে কেউ অপমানিত হলেন কি না, সে সম্বোধন আদৌ স্বতঃস্ফূর্ত কি না, আমাদের ভাবতে বয়ে গেছে। বরং, ঋতুপর্ণ ঘোষ কেন সব্বাইকে তুই-তুই করতেন— এ নিয়ে বাঙালির অনেক বেশি মাথাব্যথা।
হয়তো এ সব বখেড়া কাটাতেই, এক সময় বেশ সিরিয়াস চেষ্টা চলেছিল ইংরেজির ‘ইউ’-এর মতোই কোনও একটি ‘কমন সম্বোধন’ বাংলাতেও চালু করার। তা হলেই, তুই-তুমি-আপনি’র জটিলতা থেকে রেহাই। তখন অনেকেই সওয়াল করেছিলেন ‘আপনি’-র সপক্ষে।
তবে, ‘বিচিত্রা’-র ওই পূর্বোক্ত বিতর্কে ভারী আশ্চর্য এক প্রস্তাব রেখেছিলেন এক লেখক। মণীন্দ্রনাথ মণ্ডল। তাঁর বক্তব্য ছিল, বাঙালির একমাত্র সম্বোধন-শব্দটি হোক— ‘তাত’! তিনি লিখছেন, ‘‘তাত’ শব্দের অর্থ পিতা, পবিত্র ব্যক্তি ও স্নেহপাত্র। সুতরাং সকলকে ‘তাত’ বলা চলতে পারে।’’ তাও ভাল, হালফিলের মহাভারত-সিরিয়ালের মতো ‘তাতশ্রী’ বলেননি!
|
ছবি: সুমন চৌধুরী। |
|
|
|
|
|