পাপাইদাদের স্কুল
তিতাসের জেঠুর কর্মস্থল শিলিগুড়ি। কলেজের অধ্যাপক তিনি। দীর্ঘদিন ওখানে আছেন। বাড়িও বানিয়েছেন বাঘাযতীন পার্কের কাছাকাছি। হাতের নাগালেই কলেজ।
বছরে এক-দু’বার আসেন বারাসতে, পৈতৃক ভিটেতে।
তিতাসের বাবার ব্যবসা। মিলনকাকু, রূপককাকুর সঙ্গে কেটারিংয়ের। এমনই তার নামডাক, দূরদূরান্ত থেকেও আসে অর্ডার। ব্যবসার কারণে বাবার পক্ষে বাইরে বেরোনই দুষ্কর। তাই ছুটিছাটায় সুযোগ পেলেই তিতাস, মা এবং ঠাম্মার সঙ্গী হয়ে শিলিগুড়িতে যায়। ঠাম্মার বয়স হয়েছে। অতএব দমদম থেকে বাগডোগরা বিমান যাত্রাকেই টার্গেট করা হয়। আর বাগডোগরায় অবধারিত ভাবেই পাপাইদাদা, তিন্নিদিদি আসে ওদের রিসিভ করতে। তিতাসকে এখন পায় কে? মা, ঠাম্মা তিন্নিদিদির সঙ্গে গাড়ি করে চলে যায়। রতনকাকু জেঠুর দীর্ঘদিনের ড্রাইভার। ওদের টা-টা করেই পাপাইদাদা তিতাসকে নিয়ে বাইকে স্টার্ট দেয়। ঠাম্মা তখন গাড়ির ভেতর থেকেই চেল্লায়, ‘ও পাপাই, সাবধানে যাস বাবা’। মা ভয় ভয় চোখে, মুখে হাসি আনবার চেষ্টা করে। তিন্নি কাকিমার অবস্থা দেখে মুখ টিপে হাসে। রতনকাকু ফুট কাটে, ‘দুগ্গা, দুগ্গা’। এ রকমই হয়ে আসছে এ যাবৎ কাল।
এ বারের কেসটা একেবারে ভিন্ন। তিন্নিদিদির বিয়ে ডিসেম্বরের শেষে। যাওয়া ফাইনাল। টিকিট কাটাও সারা। পরীক্ষা হয়ে যাবে। তার পর বড় দিনের ছুটি। অতএব তিতাস মহাখুশি। ঠাম্মার শরীরটা বিশেষ ভাল যাচ্ছে না। কিন্তু নাতনির বিয়ে বলে কথা! বাবার ভাষায়, ‘বার্দ্ধক্যের ব্যারাম’কে দুয়ো দিয়ে মায়ের সঙ্গে বেরিয়ে হাতিবাগান থেকে কেনাকাটাও সেরে এল দিব্যি। রঙ্গরসিকতাতে ওস্তাদ বাবা এক দিন কাগজ পড়তে পড়তে বলল, ‘মাকে এক দিন পার্লারে নিয়ে যাবে নাকি?’ মা মুখ টিপে হেসেছিল। কিন্তু কথাটা কানে পৌঁছেছিল ঠাম্মার। ‘ইয়ারকির কী ছিরি’, বলে ছেলের দিকে কটমট করে তাকিয়ে সরোষে এক ঝাড়ি। বেশ হইহই করে শিলিগুড়ি যাওয়ার দিনটা এগিয়ে আসছিল। ঠিক দুটো বাজতে কয়েক মিনিট বাকি। প্লেনটা ছুঁল বাগডোগরার মাটি। ঝকঝক করছে প্রকৃতি। নীচে পুতুলের মতো মানুষজন, খেলনার মতো বাড়িঘরগুলো দেখতে দেখতে তিতাস সিট বেল্টটা ঠিকঠাক আছে কি না দেখে নিচ্ছিল। ঠাম্মা এই সময়টাতে চোখ বুজে থাকে। মা কিছু বলছিল ঠাম্মার কানে কানে।
ছবি: সুমন চৌধুরী।
প্লেন বা ট্রেন যা-ই হোক না কেন, নামবার সময় যাত্রীদের সব্বার এত তাড়া থাকে কেন, বুঝতে পারে না তিতাস। এয়ার হস্টেস এগিয়ে এসে জানতে চাইল, ঠাম্মার হুইলচেয়ার লাগবে কি না। ‘না, ধীরেসুস্থে চলে যাব’— ঠাম্মার স্টেট জবাব। ‘ওকে ম্যাম’, বিমান-সেবিকা মিষ্টি হেসে ঠাম্মাকে নামতে সাহায্য করে। তিতাসের ক্লাস এইট হলেও হাইট পাঁচ পাঁচ। অবলীলায় ওপর থেকে দুটো ব্যাগ নামিয়ে ঠাম্মা আর মায়ের পিছন পিছন নামে।
ছোট্ট এয়ারপোর্ট বাগডোগরা। বাইরে বেরোতেই তিন্নিদিদি ছুটে এল। পাপাইদাদা কোথায় ছিল, লাফ দিয়ে সামনে এসে একেবারে সটান ঠাম্মার পায়ের কাছে। রকমসকম দেখে মা তো হেসেই অস্থির। ‘ওঠ হতচ্ছাড়া’। ঠাম্মাকে জড়িয়ে ধরে বলে পাপাইদাদা, ‘কেমন আছো ইয়াং লেডি? তোমায় দেখলেই আমার ইচ্ছে হয় একশো বছর বাঁচি’। ঠাম্মার তখন বড় নাতির কান মুলে দিয়ে বলে, ‘সেঞ্চুরি হবে না হয়তো, তবে তোর বিয়ে দেখে যাব। কথা দিচ্ছি। আর হ্যাঁ, তিতুকে নিয়ে পাগলের মতো গাড়ি ছুটিয়ো না, তাও বলে দিচ্ছি।’
এয়ারপোর্ট চত্বর ছাড়াতেই চোখ জুড়োনো চা বাগান। সবুজে ছয়লাপ। এক টুকরো জমজমাট বাগডোগরার দোকানপাট পেরিয়ে এল তারা। রোববারের ভরদুপুরে তখন ঝিমোচ্ছে বিশাল উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়। শিবমন্দির ছাড়াতেই সেন্ট জোসেফ স্কুলের চবুতরা। তার পর মাটিগাড়াকে ডাইনে রেখে বাইক ছুটল সোজা। পাপাইদাদাকে জাপ্টে ধরে বসে ছিল তিতাস। আর বারংবার যাতায়াতে চেনা দৃশ্যপটগুলো পর পর ঝালিয়ে নিচ্ছিল। ওই তো চলে এল ‘উত্তরায়ণ’। লোপাট হয়ে যাওয়া চাঁদমণি চা-বাগানের জায়গায় ছবির মতো শপিং মল, আবাসন এলাকা। পাপাইদাদা হুট করে বাইকটা ঘুরিয়ে পার্কিং জোনে দাঁড় করায়। তিতাসকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে একছুটে গিয়ে দুটো আইসক্রিম নিয়ে আসে। ‘খা’। হুহু করে বইছিল ঠান্ডা হাওয়া। ঠান্ডার মধ্যে ঠান্ডা। ঠিক পাপাইদার মতোই জমজমাট ব্যাপার। তবে, মা আর ঠাম্মা থাকলে দেখতে হত না!
আবার ছোটা। মাল্লাগুড়ি ছাড়িয়েছে তারা। হিল কার্ট রোড ধরে পাপাইদাদের ভাষায় ‘দ্বিতীয় কলকাতা’ শিলিগুড়ি শহরে। হঠাৎই ‘বিশ্বদীপ’ সিনেমা হলকে ডাইনে রেখে বাঁ দিকে রাস্তা ধরল পাপাইদাদা। ‘বাড়ি যাবে না’? ‘অন্য একটা জায়গা হয়ে যাব, এই দেখ, এই জায়গাটার নাম ‘প্রধান নগর’। বাঁ দিকে ‘মার্গারেট স্কুল’ আমরা হাইওয়ে ছাড়িয়ে চলেছি চম্পাসারির ভেতর দিয়ে।’
উরিব্বাস! তখন যেন দূরের হিমালয় ভেঙে পড়বে গায়ে। জ্বলজ্বল করছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। পাপাইদাদা তো হরবখত বলে, ‘পৃথিবীর আর কোনও শহর থেকে এমন কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়? তাই, সকল নগরীর সেরা আমার শহর শিলিগুড়ি’। মার্ভেলাস!
দোকানপাটে ভরপুর চম্পাসারি। খানিকটা গিয়ে আবার ডান দিকে বাইক ঘোরাল। বাড়ি-ঘর ছাড়িয়ে একটা কালীমন্দির পেরিয়ে অনেকটা গিয়ে যেখানে থামল তারা, দূরে মহানন্দা। এই শীতে ক্ষীণকায়। এখানে ওখানে নাম না জানা গাছ। অনেকটা জায়গা ঘেরা দেওয়া একটা এলাকায় ঢুকে পড়ল তারা। জ্বলজ্বল করছে একটা সাইন বোর্ড ‘সবুজ পাতা’। বাইক থামাতেই তিতাস দেখল একটা দারুণ সুন্দর টিনের ছাউনি দেওয়া বাঁধানো গোলাকার জায়গা। সেখানে কুড়ি-পঁচিশটা বাচ্চা ছেলে-মেয়ে ছবি আঁকছে। একটু দূরে একটা গাছের নীচে তিন্নিদিদির মতো এক জন গাইছে, ‘আলো আমার আলো ওগো আলো ভুবন ভরা’ দশ-বারো জন বাচ্চা গলা মেলাচ্ছে। অন্য একটা গাছের নীচে পাপাইদার মতো দু’জন আবৃত্তি করছে, ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির’— কতগুলো বাচ্চা ছেলে শুনে শুনে লাইনগুলো আওড়াচ্ছে।
‘এই আমাদের রোববারের অক্সিজেন। আমি, ঋত্বিক, সোহম আর শ্রীলেখা মিলে চালাই এই গান-আঁকা-আবৃত্তির ক্লাস। জমিটা দিয়েছেন আমাদের এক বন্ধুর বাবা। সবাই আমরা এম এ ফার্স্ট ইয়ারের ব্যাচমেট। শ্রী আসে গান শেখাতে জলপাইগুড়ি থেকে। সোহম আর ঋত্বিক থাকে দেশবন্ধু পাড়ায়। আর আমি শ্রীমান, হেঁ হেঁ আপনার জানা আছে। অনেকে এগিয়ে এসে সাহায্য করেন। বাকিটা আমাদের টিউশনের টাকায় চলে। আর এই বাচ্চাগুলো আসে আশপাশের বস্তি থেকে। ভীষণ গরিব রে, দু’বেলা খেতেও পায় না ভাল করে’।
পাপাইদাদা ঘাসের ওপর বসেছিল। তিতাসের পিঠে হাত রেখে তার পর মন-কেমন-করা গলায় বলে, ‘একটাই জীবন তিতাস মুখুজ্জে। আমাদের প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু করা উচিত পরের জন্য। যতটুকু সম্ভব। এই শীতেও ওদের গরম জামা জোটে না, তাই...’।
ওরা সবাই এগিয়ে আসছিল। পাপাইদাদা পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল সবার সঙ্গে।
‘সব্বাই লাইন করে দাঁড়াও’। বাচ্চাগুলো ছুটে এসে লাইন করে দাঁড়াল। আর ঋত্বিকদা, সোহমদা দুটো ঢাউস বিগশপার নিয়ে এল। শ্রীলেখাদি একটা বিশাল ব্যাগ। বাচ্চাগুলোকে একটা করে সোয়েটার দিল ওরা চার জন। কলকল করে উঠল খুশিতে সবাই। সব শেষে পাপাইদাদা পিঠ-ব্যাগ থেকে একটা করে ক্যাডবেরি দিল ওদের।
‘এ বার আমরা তিতাসের গান শুনব তো?’— শ্রীলেখাদির কথায় অবাক হল সে।
‘হ্যাঁ, আমি বলেছি। গা। শেষটা সুন্দর হোক’। পাপাইদাদা বলল।
পাপাইদাদা যে কী করে না! হ্যাঁ, সে গান শেখে। একেবারে ছোট থেকে। কিন্তু একটা প্রস্তুতি বলেও তো ব্যাপার আছে? পাপাইদাদাকে সে কথা কে বোঝাবে?
সবাই তার দিকে চেয়ে আছে। পাপাইদাদা তার পিঠে আবার হাত রাখে। তিতাসের ভেতর থেকে উঠে আসে গান: ‘অন্ধকারের উৎস হতে উৎসারিত আলো...’
গান শেষ হতে শ্রীলেখাদি উচ্ছল গলায় বলে ওঠে, ‘এই, তুই এসে এই গানটা শিখিয়ে যাবি এদের। নেক্সট রোববারে ও থাকছে তো পাপাই?’
‘হ্যাঁ, দিদির বিয়ে তো তার পরের রোববার’।
তিতাস অনুভব করতে পারছিল, ওকে আসতেই হবে। পাপাইদাদা এবং ওর বন্ধুদের জন্য ভীষণ গর্ব হল ওর। পাপাইদাদার কথাটা মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে। একটাই তো জীবন, পরের জন্য সাধ্যানুসারে কিছু করতে পারলেই সার্থকতা পাবে মানব-জনম।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.