আলি আকবর খান বা নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়কে রাতভর ধাওয়া করে চলেছে ক’জন ডানপিটে। সন্ধেয় তারা ছিল মহাজাতি সদনে, কী ভাবে গাড়ি ম্যানেজ করে রাত শেষে ঠিক হাওড়ার শিবপুরে পৌঁছে গিয়েছে সক্কলে। শিল্পীর আহির ভৈরবের আবাহনে পুবের আকাশ তখন সবে রাঙা হতে শুরু করেছে।
কিংবা কনকনে ডিসেম্বরের রাতকে থোড়াই কেয়ার করে ভবানীপুরের ট্রামরাস্তায় সত্যাগ্রহীর মতো ঠায় বসে ছেলে-বুড়োর দলটা। মাঙ্কি-ক্যাপের ফাঁকে কানটুকু শুধু প্রাণপণ সজাগ। মাইকে বিজলী কিংবা বসুশ্রী সিনেমা হলের ভিতর থেকে ভেসে আসছে সুরমূর্ছনা।
সাবেক ডোভার লেন কনফারেন্সের ত্রিপল-ঘেরা প্যান্ডেল বা পার্ক সার্কাস ময়দানের আশপাশেও আকছার দেখা গিয়েছে এমন দৃশ্য। ত্রিপলের ফুটোয় উঁকি দিয়ে বা মাঠের ধারে ছাইগাদার পাশে ঠকঠকিয়ে কাঁপতে কাঁপতেই সুরে বুঁদ হয়েছে অখ্যাত সঙ্গীত-পাগলের দল।
তখন শীতের কলকাতার কেক-কমলালেবু বা ইডেনের টেস্টের সঙ্গে এক নিঃশ্বাসে উচ্চারিত হতো ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসর। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি--- রাতের পর রাত নক্ষত্র সমাবেশের জৌলুসে কলকাতা হয়ে উঠত রসিকজনের তীর্থস্থান। |
এখন ডোভার লেন মিউজিক কনফারেন্স বা গঙ্গাপাড়ের উত্তরপাড়া সঙ্গীত চক্রের আসর ছাড়া সে কালের সঙ্গীত-সম্মেলন বেমালুম উবে গিয়েছে। আর আছে আইটিসি সঙ্গীত রিসার্চ অ্যাকাডেমি-র কনফারেন্স। এ ছাড়া বিক্ষিপ্ত ভাবে দেখা যাচ্ছে কিছু চেষ্টা, যার লক্ষ্য পুরনো দিনগুলো ফিরিয়ে আনা।
ধ্রুপদী সঙ্গীত নিয়ে পাগলামিতে ভরপুর শীতের রাতগুলোর সাক্ষী এক দম্পতি সেই চেষ্টাতেই মেতেছেন। তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার ও মানসী মজুমদার উঠেপড়ে লেগেছেন, ধ্রুপদী সঙ্গীতের একটি নতুন আসরকে সমকালের কলকাতায় মিলিয়ে দিতে। ২০১৪-র প্রথম সপ্তাহান্তে শনি-রবি--- দু’দিন ব্যাপী ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসর এ বার প্রয়াত সরোদ-শিল্পী বাহাদুর খান সাহেবকে উৎসর্গ করা হয়েছে। সরোদিয়া তেজেন্দ্রনারায়ণ আদতে বাহাদুর খানেরই শিষ্য। এই অনুষ্ঠানের আয়োজন তাঁর কাছে এক রকম গুরুদক্ষিণা। ‘স্বরসম্রাট’ আলি আকবর খান ছিলেন বাহাদুর খান সাহেবের জেঠতুতো দাদা। তেজেন্দ্র-মানসীর সঙ্গীত-চর্চা ও শিক্ষার সংস্থা শ্রীরঞ্জনী-র উদ্যোগে ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসরটির নাম ‘স্বরসম্রাট উৎসব’। পুণের ঐতিহ্যশালী ‘সোয়াই গন্ধর্ব সঙ্গীত মহোৎসব’ যেমন ভীমসেন জোশীর নামে ‘সোয়াই গন্ধর্ব ভীমসেন মহোৎসব’ হয়ে উঠেছে, তেমনই কলকাতার এই আসরটিকে আলি আকবর খান সাহেবের নামে ‘ব্র্যান্ডিং’ করছেন উদ্যোক্তারা।
কিন্তু এই সাইবার যুগে যখন বাড়িতে বসে চাইলেই এ কাল-সে কালের শিল্পীদের স্মরণীয় উপস্থাপনা ‘ডাউনলোড’ করা যাচ্ছে, তখন এত-শত ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসরে কী আসে-যায়, এই প্রশ্নটাও অনিবার্য বইকী! তখন মহাজাতি সদন-কলামন্দির-রবীন্দ্র সদন-মিনার্ভা তো বটেই, কোনও সিনেমা-হল বা খোলা মাঠের আসরেও তিলধারণের জায়গা মিলত না। রাতের পর রাত জেগে মাটিতে বসেই রবিশঙ্কর-বিলায়েত খানদের শুনে বেঁচে থাকা সার্থক মনে করতেন শ্রোতারা। কিন্তু এখন ইন্টারনেট, ইউটিউবে সড়গড় শ্রোতা কেন অতটা ধকল সইতে যাবেন?
একদা আলি আকবর খান সাহেবের সহ-শিল্পী, সানফ্রান্সিসকোয় আলি আকবর কলেজ অব মিউজিকের চেয়ারম্যান, তবলাশিল্পী স্বপন চৌধুরী বলছেন, “শিল্পীর তাৎক্ষণিক মেজাজ ও আবহের মিশেলে গানবাজনার স্বাদটা সব সময়েই আলাদা! এর পাশে ইন্টারনেট হল দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো।” কলকাতার শ্রোতাদের কারও কারও মনে আছে, ভীমসেন জোশীর একটি অনুষ্ঠানের কথা। গাইতে গাইতে হঠাৎ কাশির দমকে আক্রান্ত শিল্পী। শ্রোতারা সহমর্মী, ধৈর্যশীল। এবং ৭-৮ মিনিট বাদে শিল্পীর ফের স্বমহিমায় প্রত্যাবর্তন।
পেশায় কলেজশিক্ষক, সত্তরের দশকের গোড়া থেকে কলকাতার ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসরের নিয়মিত শ্রোতা সুকান্তি দত্তর কথায়, “শিল্পীরা রোবট নন, মানুষ। কিন্তু সেই মানুষই স্বর্গীয় অভিজ্ঞতা উপহার দিতে পারেন শ্রোতাদের --- এটা বুঝতে অনুষ্ঠান শুনতে যেতেই হবে।”
কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি বলছে, ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসরে স্পনসরের আনুকূল্যে ভাটার টান চোখে পড়ছে সেই আশির দশক থেকেই। যখন তানসেন সঙ্গীত সম্মেলন, পার্ক সার্কাস কনফারেন্স, সদারঙ্গ সঙ্গীত সম্মেলন বা বঙ্গসংস্কৃতি সম্মেলনের মতো বড় বড় আসরগুলির একে একে নিভিছে দেউটি। এ যুগে বেহালা, গল্ফগ্রিন, শোভাবাজার, নেতাজিনগরে কিছু অনুষ্ঠান মাঝেমধ্যে হলেও স্পনসর জোগাড় করতে উদ্যোক্তারা হিমশিম খাচ্ছেন। এর ফলেই গুটিকয়েক বড়সড় সঙ্গীত সম্মেলন বা দীক্ষিত শ্রোতাদের জন্য মিউজিক সার্কেলগুলির বাইরে সাধারণ শ্রোতারা ক্রমশ ধ্রুপদী সঙ্গীত থেকে দূরে সরে যাচ্ছেন।
কলকাতার ধ্রুপদী সঙ্গীতের আসরের পোড় খাওয়া শ্রোতাদের অনেকেরই কিন্তু অভিজ্ঞতা, এ যুগে শ্রোতার মানেও অবক্ষয় দেখা দিচ্ছে। ইদানীং দেখা যাচ্ছে, তুলনায় অপরিচিত শিল্পীদের গান-বাজনার সময়ে শ্রোতারা বাইরে কফি বা বিরিয়ানির স্টলেই বেশি আগ্রহী। আশির দশকে তাঁর কলেজজীবন থেকে শুরু করে এখনও পর্যন্ত ধ্রুপদী সঙ্গীতের কোনও ভাল অনুষ্ঠানের পোকা সঙ্গীত-শিল্পী শ্রীকান্ত আচার্যের কথায়, “গান-বাজনা শুনতে পাওয়াটা সহজ হয়ে গিয়েছে বলেই বোধহয় সন্ধানের তাগিদটায় চিড় ধরছে।”
এই দুঃসময়ে জনপ্রিয় সংস্কৃতির উপাদানগুলির সঙ্গে ধ্রুপদী সঙ্গীতকে মেলানোর চেষ্টা জরুরি বলে মনে করছেন কেউ কেউ। ইউরোপে অপেরা মিউজিকের দুরবস্থার পটভূমিতেই ফুটবল ক্লাবগুলোর গানের সঙ্গে অপেরার ঘরানাকে যুক্ত করার চেষ্টা শুরু হয়েছিল। কিন্তু এ দেশে তেমন চেষ্টা কই? সেতার-শিল্পী পূর্বায়ন চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, “আজকের ব্যস্ত নাগরিক জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাধারণ মানুষ কী ভাবে ধ্রুপদী সঙ্গীত উপভোগ করতে পারবেন, সেটা ভাবতে হবে।” আইআইটি, আইআইএম-এর মতো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিকে টার্গেট করে পূর্বায়ন যেমন, ১৫-২০ মিনিটের ছোট পরিসরে এক-একটি রাগ উপস্থাপনার চেষ্টা করছেন।
‘স্বরসম্রাট’ উৎসবের মাধ্যমে তেজেন্দ্র-মানসীরাও সময়ের চাহিদা মেনেই এগোনোর কথা বলছেন। বিভিন্ন প্রজন্মের কৃতী শিল্পীদের নিয়ে এক সঙ্গে অনুষ্ঠান করার পাশাপাশি উপস্থাপনাতেও কিছু নতুনত্বের কথা ভাবা হয়েছে। ফিল্মি মিউজিকের ক্ষেত্রেও জনপ্রিয় শিল্পী শঙ্কর মহাদেবন যেমন জাকির হুসেন (তবলা), ইউ শ্রীনিবাস (ম্যান্ডোলিন), ভি সেলভাগণেশ (খাঞ্জিরা)-দের সঙ্গে গাইবেন। তবে অনুষ্ঠানের টিকিটেই ছেপে দেওয়া হয়েছে, কোনও শিল্পীর কাছেই লঘু সঙ্গীত বা ফিল্মি গানার আবদার রাখা চলবে না। ধ্রুপদিয়ানায় আপস না-করে চার শিল্পীর বোঝাপড়ায় সাঙ্গীতিক ফিউশনের আঙ্গিক সব ধরনের শ্রোতাকে ছুঁয়ে যাবে বলে উদ্যোক্তাদের বিশ্বাস। |