প্রসূতি ও গর্ভবতীর মৃত্যু কী ভাবে ঠেকানো যায়, এ বার পশ্চিমবঙ্গের কাছ থেকে তা শিখবে উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান। বিহার-ঝাড়খণ্ডের মতো পড়শিকেও তা শেখাবে বাংলা। এ ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনের সুবাদেই পশ্চিমবঙ্গকে এ হেন গুরুদায়িত্ব সঁপেছে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক।
গত ২০ ডিসেম্বর প্রকাশিত মন্ত্রকের বুলেটিনে বলা হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গে গর্ভবতী ও প্রসূতির মৃত্যু-হার ইদানীং চোখে পড়ার মতো কমেছে। এর পিছনে উন্নত চিকিৎসা পদ্ধতি ও সচেতনতা বৃদ্ধির দাওয়াই যেমন কাজ করেছে, তেমন জেলায় জেলায় মৃত্যুর কারণ খুঁজে বার করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের (ডেথ অডিট) পদ্ধতিরও যথেষ্ট অবদান বলে মন্ত্রকের অভিমত। প্রসঙ্গত, প্রতি লক্ষ গর্ভবতী-প্রসূতির মধ্যে মৃতের সংখ্যার বিচারে কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের দেশের মধ্যে পঞ্চম। যদিও ২০১০ থেকে ২০১২ এই তিন বছরে মৃত্যুর হার কমেছে এ রাজ্যেই সবচেয়ে বেশি।
এবং সেই কারণেই সংখ্যার নিরিখে সাফল্য-তালিকার শীর্ষে থাকা কেরল-মহারাষ্ট্র বা অন্ধ্রের বদলে পশ্চিমবঙ্গকেই বেছে নেওয়া হয়েছে পশ্চাৎবর্তীদের শিক্ষক হিসেবে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের মাতৃস্বাস্থ্য বিভাগের ডেপুটি কমিশনার হিমাংশু ভূষণের কথায়, “পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত এলাকার স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও গর্ভবতী ও প্রসূতিমৃত্যুর প্রতিটা ঘটনা যে ভাবে খতিয়ে দেখা হচ্ছে, তা প্রশংসার যোগ্য। এটাই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি। পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলোর শেখা উচিত।” অতএব মন্ত্রকের সিদ্ধান্ত, উত্তরপ্রদেশ-রাজস্থান-বিহার-মধ্যপ্রদেশ-ঝাড়খণ্ড বা অসমের মতো যে সব রাজ্য এখনও গর্ভবতী-প্রসূতির মৃত্যুতে তেমন রাশ টানতে পারেনি, তাদের স্বাস্থ্য-প্রতিনিধিদের দিল্লিতে ডেকে পশ্চিমবঙ্গের স্বাস্থ্য-কর্তাদের মুখোমুখি বসিয়ে দেওয়া হবে। “পশ্চিমবঙ্গের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিক বাকিরা।” মন্তব্য হিমাংশুর। |
এমন সাফল্য পশ্চিমবঙ্গ পেল কী ভাবে?
রাজ্যের স্বাস্থ্য-কর্তাদের ব্যাখ্যা, সমস্যার উৎস-সন্ধানের মধ্যেই লুকিয়ে আছে সাফল্যের রহস্য। যেমন, গর্ভবতী অবস্থায় বা প্রসবের ঠিক আগে অনেকের রক্তচাপ মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায়। ফলে খিঁচুনিতে অনেকে মারা যান। আবার অনেকের প্রাণ যায় অপুষ্টি, সংক্রমণ, রক্তাল্পতা বা প্রসব-পরবর্তী রক্তপাতে। রাজ্যের কোনও সরকারি হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এমন কোনও ঘটনা ঘটলেই মৃত্যুর কারণ লিখে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে স্বাস্থ্য দফতরের বিশেষ অবস্টেট্রিক মেন্টর গ্রুপের কাছে। তারা তা যাচাই করে পাঁচ সদস্যের কোর কমিটিকে জানাচ্ছে। ভবিষ্যতে এমন ঘটনা ঠেকাতে কী করা দরকার, কমিটি সেই মর্মে সুপারিশ পাঠাচ্ছে সমস্ত জেলার হাসপাতালে।
নিরন্তর এই প্রক্রিয়ার দৌলতেই গর্ভবতী-প্রসূতির মৃত্যুর বিরুদ্ধে একটা সার্বিক প্রতিরোধ-জাল গড়ে তোলা সম্ভব হচ্ছে বলে দাবি করছেন স্বাস্থ্যকর্তারা। মেন্টর গ্রুপের অন্যতম সদস্য তথা স্ত্রী-রোগ চিকিৎসক দেবাশিস ভট্টাচার্য বলেন, “কোনও প্রসূতি বা গর্ভবতীর মৃত্যুর কারণ খতিয়ে দেখে আমাদের যদি মনে হয় মৃত্যুটা এড়ানো যেত, তা হলে ওই রকম কেসগুলোয় আমরা বিশেষ নজরদারির ব্যবস্থা করি।” অনেক সময়ে এ-ও দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট ডাক্তারদের সিদ্ধান্ত নিতে দেরি হয়েছে। কখনও ধরা পড়ে, চিকিৎসার পরিকাঠামো যথাযথ ছিল না, কিংবা যন্ত্র খারাপ ছিল। কোথাও আবার স্বাস্থ্য-কর্মীদের তালিমের অভাবই মূল কারণ। কোথাও হয়তো লেবার রুম ঠিকঠাক জীবাণুমুক্ত না-হওয়ায় প্রসূতির দেহে সংক্রমণ ছড়িয়েছিল। এ সব থেকে শিক্ষা নিয়েই ভবিষ্যতে তার পুনরাবৃত্তি আটকানোর চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য-কর্তারা। “প্রয়োজনে বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের বিশেষজ্ঞেরা জেলার হাসপাতালে গিয়েও খোঁজ-খবর নিচ্ছেন, সেখানকার ডাক্তারদের পরামর্শ দিচ্ছেন। প্রতিটি মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধান করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়াতেই এই সাফল্য।” বলছেন দেবাশিসবাবু।
তবে দিল্লির তারিফ পেয়েও ওঁরা আত্মতুষ্ট হতে চাইছেন না। বরং সাফল্যের বহর আরও বাড়িয়ে নিয়ে যেতে সরকার সচেষ্ট। স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী জানিয়েছেন, ২০১৫-র মধ্যে দেশে প্রতি লক্ষ গর্ভবতী ও প্রসূতিপিছু মৃতের সংখ্যা ১০৯-এ নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার। কেরল তা ইতিমধ্যে ৬৬-তে নামিয়ে এনেছে। অথচ পশ্চিমবঙ্গে বিস্তর চেষ্টার পরেও সংখ্যাটা ১১৭-র নীচে আনা যায়নি। যার জন্য আঙুল উঠছে মূলত সচেতনতার অভাবের দিকে। “উত্তর দিনাজপুর, মালদহ, কোচবিহার, দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো জেলায় এখনও প্রচুর প্রসব বাড়িতে হচ্ছে। সেখানে মায়ের মৃত্যুর ঝুঁকি থাকবেই। এটা কমাতে হবে,” বলছেন বিশ্বরঞ্জনবাবু। তাই সচেতনতা শিবিরের উপরেই আপাতত জোর দিচ্ছে রাজ্যের স্বাস্থ্য-প্রশাসন। |