এক পড়শি মেয়ের অশ্লীল ছবি তিনি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন শুনেছেন তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলেন রোহিত (নাম পরিবর্তিত)। খবর ছড়াতেই থানা-পুলিশের টানাটানি। এলাকায় বদনামও কম হয়নি। শেষে মাস খানেক পর পুলিশি তদন্তে উঠে এল অন্য এক তথ্য। রোহিত নয়, আসল দোষী অন্য কেউ।
একই রকম ঘটনা ঘটেছিল অপূর্ব-র ((নাম পরিবর্তিত) ক্ষেত্রেও। তাঁর জিমেল অ্যাকাউন্ট থেকে এক বিধায়ককে ই-মেল পাঠিয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছে। তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, ওই হুমকি-মেলের প্রেরক অপূর্ব নয়, অন্য কেউ।
বান্ধবীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কিছু মুর্হূতের ছবি কম্পিউটারের ডেস্কটপের একটি ফাইলে রেখেছিলেন রকি (নাম পরিবর্তিত)। একদিন তাঁরই এক বন্ধু সেই কম্পিউটারে কিছু তথ্য আদান-প্রদান করতে আসে। কয়েক দিন পরে একটি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ওই ঘনিষ্ঠ মুর্হূতের ছবি ছড়িয়ে পড়ে।
গত কয়েক বছর ধরে এমনই কিছু ঘটনা বাঁকুড়া জেলা পুলিশের কপালের ভাঁজ বাড়িয়ে দিয়েছে। ক্রমাগত বেড়ে চলা ‘সাইবার ক্রাইমে’ লাগাম পরাতে পুলিশ তৎপরতা বাড়ালেও উপযুক্ত পরিকাঠামো এখনও গড়ে তুলতে পারেনি। ফলে ওই ধরনের অপরাধে প্রথম দিকে অপরাধীদের চিহ্নিত করতে পুলিশ কর্মীদের কালঘাম ছুটে যায়। পরে ভবানী ভবনে সিআইডি-র সাহায্য নিয়ে অপরাধীদের শনাক্ত করে জেলা পুলিশ। পুলিশ সূত্রে খবর, চলতি বছরেই বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে ছ’টি সাইবার অপরাধের ঘটনা তাদের সামনে এসেছে। বাঁকুড়া সদর থানা এলাকায় দু’টি ও বিষ্ণুপুর, বড়জোড়া, খাতড়া ও সিমলাপাল থানায় একটি করে সাইবার ক্রাইমের ঘটনা ঘটেছে। তবে ওই ঘটনা থেকে স্পষ্ট এই জেলায় ‘সাইবার ক্রাইম’ ক্রমশ ছড়াচ্ছে। জেলা পুলিশ সুপার মুকেশ কুমার বলেন, “সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাইবার ক্রাইম বাড়ছে। তবে এখনই সাইবার ক্রাইমের জন্য আলাদা সেল গড়ার প্রয়োজন নেই এই জেলায়।”
বাঁকুড়া জেলায় এখনও পর্যন্ত যে ধরনের সাইবার ক্রাইমের ঘটনা ঘটেছে, তা থেকে তদন্তকারী পুলিশকর্মীরা মনে করছেন, ব্যক্তিগত কম্পিউটারের বদলে অপরাধীরা সাধারণত সাইবার কাফের কম্পিউটার থেকেই এই ধরণের কাজ করে। তাই সাইবার কাফেগুলিতে নজরদারি শুরু করেছে পুলিশ। জেলার পুলিশ কর্তাদের মতে, বহু মানুষ সাইবার কাফেতে যাতায়াত করেন। কিন্তু তাঁদের অনেকে স্যোসাল সাইট কিংবা ই-মেল অ্যাকাউন্ট ঠিকমতো বন্ধ (লগআউট) করেন না। পরে অন্য কেউ ওই কম্পিউটার থেকে আগের ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে গণ্ডগোল পাকাতে পারেন। এমনটাই হচ্ছে অনেক সময়। ফলত দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে অন্যমনস্ক কম্পিউটার ব্যবহারকারীদের। অনেকে আবার বিশ্বাস করে নিজের অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড ঘনিষ্ঠদের জানিয়েও বিপদ ডেকে আনেন।
জেলা পুলিশের এক আধিকারিক জানান, প্রত্যেক সাইবার কাফেতে ‘রেজিস্টার বুক’ রাখার নিয়ম। সেই খাতায় সাইবার কাফেতে কোনও ব্যক্তির আসা ও বেরিয়ে যাওয়ার সময় উল্লেখ করার কথা। সাইবার কাফের কম্পিউটার ব্যবহার করতে দেওয়ার আগে ওই ব্যক্তিদের সচিত্র পরিচয় পত্র দেখে নেওয়াও নিয়ম। অথচ অনেকে ক্ষেত্রে এই নিয়ম মানা হচ্ছে না। তাতেই অপরাধীরা সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি ডিএসপি (আইন ও শৃঙ্খলা) কৃশানু রায় বাঁকুড়া শহরের কয়েকটি সাইবার কাফে পরিদর্শন করেন। তাঁর অভিজ্ঞতা, “তিনটি সাইবার কাফেতে রেজিস্টার বুক, গ্রাহকদের পরিচয় পত্র পরীক্ষা করার মতো নিয়মকানুন মানা হয় দেখলাম। কিন্তু বাকি তিনটি সাইবার কাফে এ সব নিয়ম মানছে না। প্রত্যেককে এ ব্যাপারে কড়া ভাবে সতর্ক করা হয়েছে।” তিনি জানান, নিয়মিত ওই সাইবার কাফেগুলিতে পুলিশ পরিদর্শনে যাবে। নিয়ম ভাঙা হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ওই পুলিশ কর্তা।
বাঁকুড়ার সিনেমারোড এলাকার এক সাইবার কাফের মালিক পিঙ্কেশ থাক্কর বলেন, “সাইবার ক্রাইম যে ভাবে বাড়ছে তাতে সাইবার কাফে কর্তৃপক্ষের সচেতনতার দরকার রয়েছে। আমার কাফেতে প্রত্যেক কম্পিউটারে একটি বিশেষ সফটওয়্যার ব্যবহার করা হয়। তাতে গ্রাহকরা কতক্ষণ ওই কম্পিউটার ব্যবহার করছেন, তার তথ্য নিজে থেকেই রেকর্ড হয়ে যায়।”
কিন্তু সাইবার ক্রাইমে অভিজ্ঞ পুলিশ কর্তাদের মতে, যে ধরনের অপরাধ বাঁকুড়া জেলায় এখনও পর্যন্ত জানা গিয়েছে, তা সাইবার ক্রাইমের জগতে নেহাতই ‘অ আ ক খ’ বলা যেতে পারে। কিন্তু সাইবার ক্রাইমের ব্যপ্তি এখন অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারি দফতর বা কোনও বেসরকারি কোম্পানির ওয়েবসাইট ‘হ্যাক’ করেও তথ্য ওলটপালট করে দিচ্ছে দুষ্কৃতীরা। সরকারি গোপন তথ্যও ফাঁস হয়ে যাচ্ছে। এ ছাড়া বড় হাসপাতালে রোগী সর্ম্পকে যে তথ্য কম্পিউটারে রাখা থাকে, তা বদলে দিলেও বিপদের আশঙ্কা রয়ে যায়। ক্রমশ ছড়াচ্ছে সাইবার ক্রাইমের জাল। এ জন্য কলকাতায় লালবাজারে সাইবার ক্রাইম নিয়ন্ত্রণে একটি পৃথক থানা চালু করা হয়েছে। ভবানী ভবনে তৈরি করা হয়েছে সাইবার অপরাধ নিয়ন্ত্রণের বিশেষ বিভাগ। কিন্তু জেলাগুলিতে এখনও তথৈবচ অবস্থা। বাঁকুড়া জেলায় এখনও এ জন্য আলাদা করে প্রশিক্ষিত কর্মীদের নিয়ে কোনও বিভাগ চালু করা হয়নি। ফলে এই ধরনের অপরাধের তদন্তের ক্ষেত্রে সিআইডি-র সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত দফতরের উপরেই নির্ভর করতে হচ্ছে জেলা পুলিশকে। তবে জেলা পুলিশ সুপার মনে করেন, “এ সব রুখতে সবার আগে মানুষের সচেতনতা দরকার। সাইবার কাফেগুলি যাতে সমস্ত নিয়ম কানুন মেনে চলে এ বিষয়েও নজর রাখছি আমরা।” |