বাহির পানে: দক্ষিণের টান
মাদিবার দেশে আজও উজ্জ্বল মোহনদাস
তই বা বয়স হবে ছেলেটার? বড় জোর ২৮। দক্ষিণ আফ্রিকার একটি পর্যটন সংস্থায় কাজ করেন মোগা সুবাসিসো। পর্যটকদের ডারবানের দ্রষ্টব্যগুলি ঘুরিয়ে দেখানোই তাঁর কাজ। গাড়িতে সবাই বসতেই গমগম করে উঠল সুবাসিসো-র গলা, “আজ আপনাদের নিয়ে যাব আমাদের এক নেতার বাড়িতে। তাঁর হাত ধরে এ দেশে বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে আন্দোলন দানা বেঁধেছিল। আজকের এই যে মুক্ত দক্ষিণ আফ্রিকা তাঁর জন্য। আমরা ওই নেতার কথা কোনও দিনও ভুলতে পারব না।”
সুবাসিসোর সেই প্রিয় নেতাটি কে? “আমি মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর কথা বলছি। আপনাদের নেতা হয়ে ওঠার আগে উনি এখানে সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু করেছিলেন। উনি যত না আপনাদের নেতা, তার থেকেও বেশি আমাদের।”
বাসে বসা ভারতীয় যাত্রীদের দিকে পিছন ঘুরে তাকিয়ে কিছুটা গর্বের সঙ্গেই কথাগুলি বললেন যুবকটি। আমরা ভারতীয় পর্যটক বলে যে তিনি আমাদের খুশি করার চেষ্টা করছেন এমনটা কিন্তু কখনও মনে হয়নি।
শুধু সুবাসিসোই কেন, আগের দিন ডারবানে যিনি আমাদের শহর ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন সেই জুলু যুবক ইতো বেস্টকেও গাঁধীর কথা বলতে গিয়ে ‘আমাদের নেতা’ শব্দটি কয়েক বার বলতে শুনেছি। শহর ঘোরাতে গিয়ে তিনি প্রথমেই আমাদের নিয়ে গিয়েছিলেন মহাত্মা গাঁধী রোড। ডারবান বন্দরের ধার ঘেঁষে যাওয়া রাস্তাটি অন্যতম প্রধান সড়ক। ইতো বলছিলেন, “ডারবানের যে কটা জায়গায় আমরা পর্যটকদের নিয়ে যাব তার মধ্যে অন্যতম এই রাস্তাটি। যাঁর নামে এই রাস্তা তিনি আধুনিক দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসের এক অন্যতম নায়ক।”
গাঁধীর বাড়ির ভিতরে সংগ্রহালয়।
শুধু ডারবানই কেন! কেপটাউনের অদূরে রবেন আইল্যান্ডের জেলখানায় গিয়ে ম্যান্ডেলার সহযোগী ইতো মেলেইনও বলেছিলেন গাঁধীর কথা। ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে মেলেইনরা গড়ে তুলেছিলেন জঙ্গিবাহিনী। কিন্তু পরে ম্যান্ডেলা গাঁধীর পথ অনুসরণ করে সত্যাগ্রহের রাস্তা ধরেছিলেন। ম্যান্ডেলা তাঁর সহকর্মীদের উদ্দেশে বলেছিলেন, তিনি জেলে থেকেই মরতে চান। এটা তাঁর অহিংস প্রতিবাদ।
রবেন আইল্যান্ডে যে গাইড আমাদের বাসে করে সব ঘোরাচ্ছিলেন তাঁর মুখেও একাধিক বার শোনা গিয়েছে গাঁধীর নাম। আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস এক নেতার মন্তব্য উদ্ধৃত করে ওই গাইড হ্যারিস বলছেন, “নেলসন ম্যান্ডেলা যদি দক্ষিণ আফ্রিকার পিতা হন, তবে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধী পিতামহ।”
ডারবান শহরের বিভিন্ন দ্রষ্টব্যে গিয়ে ইতো বেস্ট দু’বার পাক খেলেন ডারবান স্টেশনকে ঘিরে। কারণ, ওই স্টেশনের সঙ্গে গাঁধীর জীবনের বড় অংশ জড়িয়ে ছিল। বেস্ট বললেন, “এখান থেকে ট্রেনে চেপে জোহানেসবার্গ যাওয়ার পথে পিটারমারিসবার্গ স্টেশনে গাঁধীকে ট্রেনের প্রথম শ্রেণির কামরা থেকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। গাঁধী তখন কয়েক জন ভারতীয় ব্যবসায়ী এবং ভারত থেকে আনা ক্রীতদাসদের ভোটার তালিকায় নাম তোলার জন্য আইনি পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করছেন। সেই কাজে যাওয়ার জন্য ট্রেনে উঠেছিলেন। কিন্তু সাদা চামড়ার নন বলে তাঁকে জোর করে নামিয়ে দেওয়া হয়। এর প্রতিবাদেই শুরু হয় গাঁধীর আন্দোলন।”
ডারবানে আমাদের তৃতীয় দিনের গাইড সুবাসিসোর কথায়, “দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে, বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে সম্ভবত এটিই প্রথম প্রতিবাদ। আমাদের ইতিহাসে মহাত্মার ভূমিকা তাই এত গুরুত্বপূর্ণ।” তিনি জানালেন, এটি আসলে ম্যান্ডেলার কথা। ১৯৯৩-এর ৬ জুন পিটারমারিসবার্গে গাঁধীর একটি মূর্তির আবরণ উন্মোচন করতে গিয়ে এমনই বলেছিলেন ম্যান্ডেলা।
ডারবানে মহাত্মা গাঁধী রোড। ফোনেক্সে গাঁধীর বাড়ি।
আমরা অবশ্য প্রথম থেকেই উসখুস করছিলাম গাঁধীর বাড়ি দেখার জন্য। আমাদের উৎসাহে সুবাসিসো গাড়ি ঘোরালেন ডারবানের উপকণ্ঠে ফোনেক্স জনপদের দিকে। যাওয়ার পথে সুবাসিসো ধারাবিবরণী দিচ্ছিলেন, “যে বাড়িটি দেখতে যাচ্ছি সেখানেই গাঁধী অহিংসা মন্ত্রে দীক্ষিত করেছিলেন দক্ষিণ আফ্রিকার কালো মানুষদের।”
এক সময়ে পৌঁছে গেলাম ফোনেক্সে। বড় রাস্তা দিয়ে ডান দিকে ঘুরে গাড়ি দাঁড়াল একটি সবুজ বাড়ির সামনে। বাড়িতে ঢুকতেই কানে এল ‘রামধুন’। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। এই গান শুনে কিছুটা হোমসিক হয়ে পড়লাম যেন। গাঁধী ওই বাড়িতে কত দিন ছিলেন, তিনি এই বাড়িতে কী কী করেছেন তা জানার জন্য কোনও গাইডের দরকার হয় না। সার সার ফলকে সবই লেখা আছে। চার দিকে ছড়িয়ে আছে বাপুর স্মৃতি। তাঁর ব্যবহৃত চরখা, বসার জায়গা, ছোট টেবল সব সযত্নে রক্ষিত। এমনকী বাড়ির পিছনে আমগাছটিও রয়েছে। ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী।
তবে এটি বাপুর আসল বাড়ি নয়। সুবাসিসো বললেন, “আমাদের দেশের বর্ণবিদ্বেষী সরকার ওই বাড়িটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। ১৯৯৪-এ নতুন সরকার এসে ফের বাড়ি এবং সংগ্রহশালাটি তৈরির সিদ্ধান্ত নেয়। ২০০০-এ নতুন এই বাড়িটি খুলে দেওয়া হয় পর্যটকদের জন্য।
আগের বাড়ির সঙ্গে এ বাড়ি হুবহু এক। আমাদের দেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ভবনটি জাতির উদ্দেশে উৎসর্গ করেন।”
বাপুর জন্য এক জন ভারতবাসী হিসেবে তখন গর্বে বুকটা ফুলে উঠেছিল।

—নিজস্ব চিত্র।



অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.