|
|
|
|
শিল্প সন্ধানে নয়া কান্ডারি |
পার্থর ‘ভার’ কমিয়ে অমিতে আস্থা মমতার |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
সরকার গড়ার আড়াই বছরের মাথায় মন্ত্রিসভায় বড় মাপের ঝাঁকুনি দিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বৃহস্পতিবার সেই রদবদলের সবচেয়ে বড় চমক হল পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের হাত থেকে শিল্প দফতর অমিত মিত্রের কাছে চলে যাওয়া। এত দিন অর্থ ও আবগারি দফতরের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন অমিতবাবু। এ বার যুক্ত হল শিল্প, শিল্প পুনর্গঠন এবং অধিগৃহীত সংস্থা বিষয়ক দফতর। আর পার্থবাবুর হাতে রইল শুধু পরিষদীয় এবং তথ্যপ্রযুক্তি দফতর।
এ দিন সব মিলিয়ে ১৪টি দফতরে অদলবদল করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু সব ছাপিয়ে প্রশাসনিক কর্তা ও রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে একটিই আলোচ্য, কেন সরানো হল পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে?
মুখ্যমন্ত্রীর ব্যাখ্যা, “মন্ত্রী হওয়ার পাশাপাশি পার্থদা দলের মহাসচিব। অনেকগুলো দফতর তাঁর হাতে ছিল। বেশ কয়েকটি মন্ত্রিগোষ্ঠীরও সদস্য তিনি। তাঁকে একটু হালকা করে দিতেই শিল্প দফতর থেকে সরাতে হল।” আর অমিতবাবু প্রসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য, “আমরা আরও একটু ভাল করে শিল্প করার জন্য অর্থমন্ত্রীর হাতে দফতরটা দিলাম। বিনিয়োগ টানার এবং শিল্প সম্ভাবনা তৈরির ক্ষেত্রে রাজ্য এগিয়ে যাবে এই আশা রইল।” |
|
ত্রয়ী। রাজভবনে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের
সঙ্গে অমিত মিত্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায়। ছবি: দেবাশিস রায়। |
কিন্তু পার্থবাবুর চাপ কমাতে শিল্প দফতর কাড়া হলেও অর্থ ও আবগারির মতো গুরুভার দফতর সামলে অমিতবাবু শিল্পে লগ্নি টানার কাজে কতটা সময় দিতে পারবেন, সেই প্রশ্ন এ দিন থেকেই উঠতে শুরু করেছে। একই সঙ্গে প্রশ্ন উঠেছে এত দিন মন্ত্রিসভার দু’নম্বর মুখ বলে পরিচিত পার্থবাবুর ভূমিকা এ বার থেকে কী হবে, তা নিয়েও। মমতা বলেছেন, “পার্থদা এখন থেকে আমাকে সাহায্য করবেন। প্রশাসন পরিচালনায় এই কাজও জরুরি।” পাশাপাশি দলের কাজে পার্থবাবুকে বেশি করে লাগানো হবে বলেও জানিয়েছেন মমতা।
শিল্প দফতর হাতছাড়া হওয়ার পরে প্রকাশ্যে কোনও ক্ষোভ প্রকাশ করেননি পার্থবাবু। এ দিন নবান্নে তিনি বলেছেন, “মুখ্যমন্ত্রী যা ভাল বুঝেছেন তাই করেছেন। আমাকে দল ও সরকারের মধ্যে প্রধান সমন্বয়কারীর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন দফতর কেমন কাজ করছে, এখন থেকে তার উপর নজরদারি করব।” মন্ত্রী না-থাকলেও শিল্পোন্নয়ন নিগমের চেয়ারম্যান পদ থেকে যে তিনি এখনই সরছেন না, তা জানিয়ে দেন পার্থবাবু। তবে ছেড়ে দেবেন হলদিয়া পেট্রোকেমের চেয়ারম্যান পদ।
আর অমিতবাবুর কথায়, “মুখ্যমন্ত্রী যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তা পালনে আন্তরিক থাকব। পুরোদমে পরিশ্রম করে মুখ্যমন্ত্রীর প্রত্যাশা পূরণ করাই হবে আমার কাজ।”
পার্থবাবুর হাত থেকে শিল্প দফতর কেড়ে নেওয়া হতে পারে, প্রশাসনিক মহলে এই গুঞ্জন শুরু হয়েছিল গত শুক্রবার টাউন হলে মুখ্যমন্ত্রীর পর্যালোচনা বৈঠকের পর থেকেই। সে দিন মুখ্যমন্ত্রীর প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছিল পার্থবাবুর দফতরগুলি। অন্য দিকে, অমিতবাবুর প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর বাড়তি আস্থা প্রশাসনিক কর্তাদের অনেকেরই নজর এড়ায়নি। সে দিনের বৈঠকে অর্থ দফতরকে মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যেই রাখা হয়নি। এমনকী, তথ্যপ্রযুক্তি দফতরের এক আমলা অর্থ দফতরের বিরুদ্ধে ৩০ কোটি টাকার নানা প্রকল্প আটকে রাখার অভিযোগ তুললেও বিন্দুমাত্র আমল দেননি মুখ্যমন্ত্রী।
প্রশাসনের একাধিক কর্তা এবং তৃণমূলের কিছু নেতা বলছেন, অমিতবাবুর প্রতি মুখ্যমন্ত্রীর আস্থার সূত্রপাত মুম্বইয়ের শিল্প সম্মেলন থেকে। এর আগে দিল্লির শিল্প সম্মেলন ও হলদিয়ার ‘বেঙ্গল লিডস’ আয়োজনের মূল দায়িত্ব ছিল পার্থবাবুর হাতে। কিন্তু শিল্পপতিদের উপস্থিতির নিরিখে ওই দুই সম্মেলনই তেমন সফল নয় বলে সমালোচিত হয়েছিল। এর পর মুম্বই সম্মেলনের দায়িত্ব অমিতবাবুর হাতে তুলে দেন মুখ্যমন্ত্রী। দেশের প্রথম সারির বেশ কিছু শিল্পপতির পাশাপাশি খোদ মুকেশ অম্বানীকে হাজির করে এবং তাঁর সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর আলাদা বৈঠকের ব্যবস্থা করে প্রথম দফাতেই সাফল্য পান অর্থমন্ত্রী। ঘনিষ্ঠ মহলে এ জন্য অমিতবাবুর প্রশংসাও করেছিলেন মমতা। অনেকের মতে, শিল্প দফতরে পার্থবাবুর দিন গোনার শুরু হয় তখন থেকেই। |
রদবদল এক নজরে |
নতুন মুখ |
বিনয় বর্মন: বনমন্ত্রী
শশী পাঁজা: নারী ও শিশুকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী স্বাধীন দায়িত্ব
|
দফতর বদল |
অমিত মিত্র: অর্থ, আবগারি, শিল্প, শিল্প পুনর্গঠন(অর্থ, আবগারি)
পার্থ চট্টোপাধ্যায়: তথ্যপ্রযুক্তি, পরিষদীয়(শিল্প, শিল্প পুনর্গঠন, তথ্যপ্রযুক্তি, পরিষদীয়)
শঙ্কর চক্রবর্তী: পূর্ত(সমবায়)
নুরে আলম চৌধুরী: পরিকল্পনা(প্রাণিসম্পদ বিকাশ)
সুদর্শন ঘোষ দস্তিদার*: পরিবেশ(পূর্ত, পরিবেশ)
সাবিত্রী মিত্র: সমাজকল্যাণ(নারী ও সমাজকল্যাণ)
শ্যামাপদ মুখোপাধ্যায়: বস্ত্র (শিশুকল্যাণ)
রচপাল সিংহ: সমবায় (পরিকল্পনা)
স্বপন দেবনাথ: ক্ষুদ্রশিল্প, প্রাণিসম্পদ বিকাশ প্রতিমন্ত্রী
স্বাধীন দায়িত্ব (ক্ষুদ্রশিল্প)
বেচারাম মান্না: কৃষি, কৃষি বিপণন, ভূমি (কৃষি, কৃষি বিপণন)
(বন্ধনীতে পুরনো দফতর) |
বাদ পড়লেন |
হিতেন বর্মন: বনমন্ত্রী |
* সুদর্শন ঘোষ দস্তিদার ছুটিতে থাকায় তিন মাস অতিরিক্ত দায়িত্ব হিসেবে পরিবেশ দফতর দেখবেন অনগ্রসর শ্রেণি উন্নয়ন মন্ত্রী উপেন বিশ্বাস |
|
কিন্তু শুধু মন্ত্রী বদলেই কি বদলে যাবে রাজ্যের শিল্পচিত্র? শিল্পমহলের অনেকেই তেমনটা মনে করছেন না। তাঁদের মতে, শিল্পপতিরা কোনও রাজ্যের প্রতি আকৃষ্ট হবেন কি হবেন না, তার অনেকটাই নির্ভর করে সে রাজ্যের শিল্পনীতির উপরে। মমতার সরকারের জমিনীতি নিয়ে অনেক শিল্পপতিরই সংশয় রয়েছে। যে ভাবে বেসরকারি শিল্পের জন্য এক ছটাক জমি অধিগ্রহণ না-করার কথা বলেছে রাজ্য, যে ভাবে কেন্দ্রের আর্জি সত্ত্বেও শহরাঞ্চলে জমির ঊর্ধ্বসীমা আইন প্রত্যাহারে অনীহা দেখিয়েছে, গ্রামাঞ্চলে সিলিং বহির্ভূত জমিতে ছাড়পত্র দেওয়ার বিষয়টি সরকারের ইচ্ছাধীন করে রেখেছে তাতে এখানে লগ্নি করতে উৎসাহ দেখাচ্ছেন না তাঁরা। শিল্পপতিদের তোলা এই সব প্রশ্নের সমাধান না-করে শুধু মন্ত্রী বদলালে প্রত্যাশিত ফললাভ হবে না বলেই মনে করে শিল্পমহলের একটা বড় অংশ।
অমিতবাবু নিজেও মানছেন, শিল্প দফতরের ভার সামলানোটা ‘নতুন চ্যালেঞ্জ’। তবে একই সঙ্গে তাঁর মন্তব্য, “টিম ওয়ার্কের মাধ্যমে বিনীত ভাবে রাজ্যের শিল্পোন্নতির চেষ্টা করে যাব। মুখ্যমন্ত্রী যে দায়িত্ব দিয়েছেন, তা পূরণে আমার দিক থেকে কোনও ত্রুটি থাকবে না।”
ঘটনা হল, তাঁর দিকে থেকে চেষ্টার কোনও ত্রুটি ছিল না বলে এ দিন দাবি করেছেন পার্থবাবুও। এমনকী, শিল্পমন্ত্রী হিসেবে শেষ দিনেও মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি লগ্নির পাঁচটি প্রকল্পের জন্য চূড়ান্ত ছাড়পত্র আদায় করে নিয়েছেন তিনি। যদিও সরকারের একটি পদস্থ সূত্রের দাবি, পার্থ নয়, অমিতের দিকে তাকিয়েই প্রকল্পগুলিতে সবুজ সঙ্কেত দিয়েছেন মমতা। |
|
|
|
|
|