অন্ধকার টানেল থেকে বেরিয়ে সবেগে প্লাটফর্মে ঢোকার মুখে আচমকা ঝাঁকুনি দিয়ে নিশ্চল হয়ে গেল ট্রেন। প্ল্যাটফর্মে যাত্রীদের মধ্যে তখন তুমুল চাঞ্চল্য। ব্যাপারটা কী?
গার্ড ইন্টারকমে চালককে ধরতে চাইলেন। ও প্রান্তে কোনও সাড়া নেই! ততক্ষণে অবশ্য মেট্রো-কর্মীরা ড্রাইভারের কেবিনের কাছে পৌঁছে গিয়েছেন। এবং আঁতকে উঠেছেন সামনের দৃশ্য দেখে। লাইনে পড়ে রয়েছে একটি মেয়ের ছিন্নভিন্ন, রক্তাক্ত দেহ। কলকাতা মেট্রোয় আত্মহত্যার আর একটা ঘটনা।
কিন্তু চালকের কী হল?
দেখা গেল, কেবিনের ড্যাশবোর্ড থেকে হাত সরিয়ে তিনি থরথর করে কাঁপছেন। চোখ কোটর থেকে ঠেলে বেরিয়ে আসছে। তাঁরই চালানো ট্রেনের ধাক্কায় তালগোল পাকিয়ে যাওয়া শবদেহটির দিকে তাকিয়ে আছেন নির্নিমেষে। ঘামছেন দরদরিয়ে। তিনি যে সুস্থ নন, বুঝতে এক লহমাও লাগে না।
সহকর্মীরা ওঁকে তাড়াতাড়ি কেবিন থেকে নামিয়ে পাঠালেন ডাক্তারের কাছে। পরে জানা গেল, এই প্রথম তিনি এ ধরনের দুর্ঘটনার মধ্যে পড়েছেন। নিজের চালানো ট্রেনের সামনে এক জনকে এ ভাবে মরতে দেখে স্নায়ুকে স্বাভাবিক রাখতে পারেননি। পরের তিন দিন ট্রেনও চালাতে পারেননি। বাড়ির লোক জানিয়েছেন, ঘরে শুধু চুপচাপ বসে থাকতেন। বিড়বিড় করতেন। রাতে ঘুমোতে পারতেন না। পরিজনদের সঙ্গে কথাবার্তাও কমিয়ে দিয়েছিলেন।
শুধু উনিই নন। মেট্রোর আত্মহত্যার ঘটনার মধ্যে পড়া বহু চালকেরই এই হাল হয়েছে। মারাত্মক স্নায়ু-চাপের শিকার হয়ে অনেকে বেশ ক’দিন ট্রেন চালাতে পারেননি। দুঃসহ সেই স্মৃতি পরেও অনেককে তাড়া করে বেড়িয়েছে। এক চালকের কথায়, “সেই থেকে প্রতি বার প্ল্যাটফর্মে ঢোকার সময়ে আতঙ্ক তাড়া করে। মনে হয়, এই বুঝি কেউ ঝাঁপ দিল। মন দিয়ে ট্রেন চালাতে পারি না।”
কেন এমন হয়? দাওয়াই বা কী? |
মনোবিদ জয়রঞ্জন রামের ব্যাখ্যা, “এ সব ক্ষেত্রে চালকদের যেটা হয়, সেটাকে আমরা বলি পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজর্ডার (পিটিএসডি)। আচমকা কোনও বীভৎস ঘটনার সম্মুখীন হলে যা হতে পারে। এতে কাউন্সেলিং দরকার।”
তবে সব সময়ে কাউন্সেলিং করেও বিশেষ লাভ হয় না বলে দাবি সমাজবন্ধু (কাউন্সেলর) মোহিত রণদীপের। তখন ওষুধ লাগে। ‘‘প্রথমে বুঝতে হবে, চালকের মনে ও শরীরে ঘটনাটি কতটা প্রভাব ফেলেছে। সেই মতো চিকিৎসা করতে হবে।” বলছেন তিনি। মোহিতের মন্তব্য, “আমি এক মেট্রো-চালকের কথা জানি, যাঁর ট্রেনে এক মহিলা কাটা পড়েছিলেন। ভদ্রলোক শারীরিক ও মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। ঘুম হতো না, খিদে কমে গিয়েছিল। নিজেকে অপরাধী ভাবতে শুরু করেন। শেষমেশ ওঁকে মনোচিকিৎসকের কাছে পাঠিয়ে বেশ কিছু দিন ওষুধ খাওয়াতে হয়েছে।”
কিন্তু সাধারণ ট্রেনের চালকেরাও তো হামেশা এমন পরিস্থিতির মুখে পড়েন! এবং সাধারণ অভিজ্ঞতা বলছে, ওঁদের অধিকাংশ সাময়িক অবসাদগ্রস্ত হলেও চটজলদি তা কাটিয়ে ওঠেন। মেট্রো রেলের চালকেরা এত চাপে পড়ছেন কেন?
এর একটা উত্তর রয়েছে মানব প্রযুক্তিবিদ (আর্গোনমিস্ট) অনিন্দ্য গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে। যাঁর দাবি, খোলা আকাশের নীচে আর মাটির তলায় আবদ্ধ পরিবেশে ট্রেন চালানোয় বিস্তর ফারাক। “মাটির উপরে চালক প্রতি মুহূর্তে নতুন নতুন দৃশ্য দেখতে দেখতে যান। কিন্তু মেট্রো-চালকের দৃষ্টি আটকে থাকে টানেলের একই রকম অন্ধকারে। সুড়ঙ্গের দেওয়ালও থাকে ট্রেনের গা ঘেঁষে, যেন মাথার উপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। সব মিলিয়ে মেট্রো-চালকদের মানসিক চাপ এমনিতেই বেশি। তাই এক বার কেউ কাটা পড়লে সেই দৃশ্যটাই ওঁদের চোখের সামনে বার বার ভেসে ওঠে।” যুক্তি অনিন্দ্যবাবুর।
বস্তুত এমন অবস্থায় ওঁদের ট্রেন চালাতে দেওয়া উচিত নয় বলেও মনে করছেনন মনোবিদ ও আর্গোনমিস্টদের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, এতে শুধু চালকের নয়, যাত্রীদেরও বিপদ হতে পারে। তবে তা যে সব সময়ে সম্ভব হয় না, মেট্রো-কর্তৃপক্ষের কথায় তা পরিষ্কার। এক কর্তা বলেন, “আমরাও জানি, এমন ঘটনার পরে সংশ্লিষ্ট চালককে কিছু দিন ছুটিতে পাঠানো উচিত। কিন্তু আমাদের ড্রাইভারের সংখ্যা কম। তাই ওঁদের বড় ছুটিতে পাঠালে মেট্রো পরিষেবা চালু রাখতে সমস্যা হবে।”
এ তো গেল কলকাতা। বিদেশের ছবিটা কী?
পশ্চিমী দুনিয়াতেও টিউব রেলের লাইনে ঝাঁপের ঘটনা ঘটে। যদিও সংখ্যায় তা কলকাতার তুলনায় কম। কিছু দিন আগে আর্থিক মন্দার তুঙ্গ সময়ে তা কিছুটা বেড়ে গিয়েছিল। এমনকী, তখন আত্মহত্যার জেরে খাস লন্ডনে কয়েক বার টিউব পরিষেবা থমকে গিয়েছিল বলে জানিয়েছেন লন্ডনের বাসিন্দা পলা চট্টরাজ। সেখানকার টিউব-চালকদের স্নায়ু-চাপ কাটানোর কী ব্যবস্থা?
জানা গিয়েছে, লন্ডন টিউব রেলের কর্তৃপক্ষ এ জন্য চালকদের বিশেষ মানসিক প্রশিক্ষণ চালু করেছেন। তাতে সামিল করা হয়েছে অনেক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাকে, যারা প্রয়োজন মতো দীর্ঘ দিন ধরে বিধ্বস্ত চালকদের কাউন্সেলিং ও চিকিৎসা করে। চিকিৎসা চলাকালীন ওঁদের ট্রেন চালাতে দেওয়া হয় না। উপরন্তু আত্মহত্যায় রাশ টানতে প্ল্যাটফর্মে রক্ষীর সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। সিসিটিভি মারফত প্রতি মুহূর্তে খেয়াল রাখা হয়, প্ল্যাটফর্মে কোনও যাত্রী কোনও রকম অসংলগ্ন আচরণ করছেন কি না।
কলকাতায় এমন কোনও উদ্যোগ?
কলকাতা মেট্রোর জনসংযোগ আধিকারিক (সিপিআরও) রবি মহাপাত্র বলেন, “আমরাও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সঙ্গে যুক্ত মনোবিদের সহায়তা নিই। প্রয়োজনে ওই সব চালককে পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব রেলের হাসপাতালে পাঠানো হয়।” পাশাপাশি বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষকেও সচেতন করতে চাইছে মেট্রো। “চালকদের মানসিক ক্ষতি সম্পর্কে বিজ্ঞাপন তৈরির পরিকল্পনা আমাদের মাথায় রয়েছে। চালক চাপে থাকলে যে যাত্রীদেরও বিপদ, তা প্রচার করা হতে পারে। এ নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরির কথাও ভাবা হচ্ছে।” বলেন সিপিআরও।
দিল্লির মেট্রো রেলে অবশ্য এখনও আত্মহত্যা সে ভাবে মাথা চাড়া দেয়নি। দিল্লি মেট্রোর মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক অনুজ দয়াল বলেন, “যে দু’-একটা হয়েছে, তাতে ড্রাইভারদের উপরে তেমন প্রভাব পড়া উচিত নয়। তবে বার বার ঘটলে আমাদেরও ব্যাপারটা নিয়ে ভাবতে হবে।” |