বাংলা ছবির শোলে
‘চাঁদের পাহাড়’ কেন এত দিন বাংলায় ছবি হয়নি তা কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের ‘চাঁদের পাহাড়’ দেখলে মুহূর্তে মালুম হয়ে যাবে। ‘মুহূর্ত’টা একটু বাড়িয়ে বলা হল। বলা যায় ওপেনিং টাইটেল পড়ার আগেই।
পনেরো কোটির ছবি বলেই নয়। এর চেয়ে ঢের বেশি টাকা হিন্দি ছবিতে অপব্যয়িত হয়েছে। বাঙালি যুবা শঙ্করের যে প্যাশন চিত্রিত করতে বিভূতিভূষণ সেই ছিয়াশি বছর আগে তাঁর পাঠককে নিয়ে গিয়ে ফেলেছি লেন আফ্রিকার জঙ্গলে (বাংলা কিশোর অ্যাডভেঞ্চার সাহিত্যে যাকে একটা অগ্রঝাঁপ বলা যায়) তা যে আধুনিক ফিল্ম-টেকনিকের প্রয়োগে কোনও বাঙালির হাতে চলচ্চিত্রিত (চলচ্চিত্রায়িত বলছি না) হতে পারবে এমন স্বপ্ন আমি দেখেছি বলে মনে হয় না।
চলচ্চিত্রিত বলেছি কারণ চিত্রনাট্য পরিচালনা, শব্দ, সঙ্গীত, অভিনয়, যাবতীয় যন্ত্রবিদ্যা করণকৌশল পেরিয়ে শেষ অবধি এক অপরূপ চিত্রশালা হিসেবে মনে বাঁধা পড়ে ‘চাঁদের পাহাড়।’ ইংরেজিতে যে জাতের ছবিকে বলে স্পেকটেকল। স্পেকটেকল হল সেই জাতের ছবি যা ছোটদের মনে মনে বড় করে দেয়। আর বড়দের মনে মনে ছোট।
বিভূতিভূষণ হয়তো এই স্পেকটাকুলারিটি চেয়েছিলেন।
যে জন্য তাঁর লেখায় খুব যে কাহিনি সঞ্চার করেছেন তা নয়। বরং ভূগোল, ইতিহাস, কিছু নৃতত্ত্ব ও বিজ্ঞানের সমাবেশে ক্রমাগত দৃশ্যের পর দৃশ্য ও রোমাঞ্চ রচনা করেছেন। ওঁর গল্পের খুঁটি বলতে এক তরুণ বাঙালিকে অদ্ভূত, অবিশ্বাস্য সব পরিবেশে নিক্ষেপ করা। ‘ডিয়েগো অ্যালভারেজের কথা’ বলে শঙ্করের নবলব্ধ দোসরের যে বৃত্তান্ত দিয়েছেন তাও আসলে আর এক দৃশ্য, পরিস্থিতি ও রোমাঞ্চমালা।
কমলেশ্বর হস্তক্ষেপ করেননি বিভূতিবাবুর বিবরণে। তবে ভয়েসওভারে উপন্যাসের নানা তথ্য ও সূত্রকে গেঁথে গেঁথে একটা কাহিনির পট তৈরি করেছেন। চিত্রনাট্যের দুর্বলতা যদি সত্যি কোথাও থেকে থাকে তবে তা এইখানে, অর্থাৎ উপন্যাসকে এত সরল ও বিশ্বস্ত ভাবে অনুকরণ করা (অনুসরণও বলছি না) যে একটা সময়ের পরে দর্শকের মধ্যে একটা মানবিক নাট্য ও গল্পের তেষ্টা পায়। আরও নাট্যায়িত হলে, সিনেমার লজিকে গল্পের বিস্তার হলে ‘চাঁদের পাহাড়’ সত্যি একটা হিরের টুকরো ছবি হত।
কিন্তু তাও যা হয়েছে ‘চাঁদের পাহাড়’ তা ১০০- ২০০ কোটি ক্লাবের যে কোনও হিন্দি ছবির থেকে ১০০-২০০ গুণ শ্রেয়। এ ছবিকে যদি বলা হয় বাংলা ছবির ‘শোলে’ তা হলেও কম বলা হবে। প্রকৃত সাহিত্যকর্মকে আঁকড়ে বাঙালি দর্শককে এক স্বপ্নিল জগতে প্রক্ষেপ করার স্বপ্ন দেখেছেন কমলেশ্বর। মনে রাখতে হবে আজকের দিনে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, প্ল্যানেট আর্থ, অবশ্যই বিবিসি, সিএনএন ইত্যাদির বদান্যতায় পৃথিবীর কোনও দৃশ্য, কোনও তল্লাটই আর অচেনা নেই দর্শকের। সেখানে কেবল দক্ষিণ আফ্রিকায় আট কোটি টাকা ব্যয়ে আউটডোরে এবং কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে পোস্ট প্রোডাকশন করে যে-আড়াই ঘণ্টার বিনোদন নির্মাণ করেছেন ভেঙ্কটেশ ফিল্মস ও কমলেশ্বর তা বাংলা ছবির দুনিয়ায় রূপকথা হয়ে থাকবে।
‘চাঁদের পাহাড়’য়ের কাহিনি শোনানোর খুব দরকার আছে কি! তবু একটুখানি বলে নিই আজকের দর্শকের হ্যারি পটার ছেড়ে বিভূতিভূষণ পড়ার সময় হয় কি?
শঙ্কর অজ পাড়াগাঁয়ের ছেলে, তাও আজকের নয়, সেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পূর্বেকার। সে এফ এ পরীক্ষায় পাশ দিয়েছে, মায়ের ইচ্ছে সে শ্যামনগর বা নৈহাটির কোনও পাটের কলে চাকরি নিক। সংসারে বড় অর্থক্লেশ। অথচ শঙ্করের ভেতরটা ভবঘুরে। ফ্যাকট্রির ভোঁয়ে বাঁধা জীবন তার জন্য নয়। জার্মান ভূপর্যটক অ্যান্টন হাউপ্টম্যানের লেখা আফ্রিকার ‘মাউন্টেন অব দ্য মুন’ বা ‘চাঁদের পাহাড়’ চড়ার বৃত্তান্ত ওকে গ্রাস করে রাখে। ও ওই চাঁদে চড়ার স্বপ্ন দেখে।
বরাতজোরে ওর ওই আফ্রিকারই মোম্বাসায় একটা চাকরি হঠাৎ করে জুটে যায়। দ্যাখ না দ্যাখ শঙ্কর এক পাণ্ডববর্জিত ঘেসো প্রান্তরে, বলতে গেলে সভ্যতার শেষ সীমায়, এক রেলস্টেশনে স্টেশনমাস্টার হয়ে গেল। স্টেশন বটে, তবে সারাদিনে উগান্ডা ব্রিটিশ রেলের একটাই গাড়ি ঢুঁ মারে। বাকি সময়টা ওর ছুটি বা কাটাতে হয় প্রতিবেশী সিংহকুল ও বিষাক্ত মাম্বা গোখরোর সঙ্গে। কিন্তু বিভূতিবাবুর নায়ক পিঠটান দেওয়ার বান্দা নয়। একটু একটু করে শুরু হয় ওর চাঁদের পাহাড়ের দিকে পা বাড়ানো। কী ভাবে? সেটা রুপোলি পর্দায় দেখাই বাঞ্ছনীয়।
‘চাঁদের পাহাড়’কে কমলেশ্বর শুধু থ্রিলার নয়, একটা ফিল গুড ছবিও করতে চেয়েছেন। যে-জন্য চরিত্রদের পোশাক-আশাক আর সেট ডিজাইনিংয়ে সব কিছু দামি, চকচকে, নয়নাভিরাম করার ব্যবস্থা করছেন। শঙ্করের পোশাক সময়ানুগ। তবে ওই সময়কার, ওই জঙ্গুলে স্টেশনমাস্টারের কড়িতে কুলোবার নয়। স্টেশন ঘরের ভেতরটাও অতি মনোরম। হলিউড-বলিউড যেমন বানায়। বিভূতিবাবুর কল্পনার ঢের বাইরে। কিন্তু যেহেতু কোটি কোটি টাকার লগ্নি এখানে, সে জন্য চোখের আরামের একটা দাবি থাকে।
আর চক্ষুকর্ণের যে বিনোদন ছড়ানো ‘চাঁদের পাহাড়’য়ে তাতে পনেরো কোটির প্রতিটি পাইয়ের ব্যাখ্যা আছে। প্রথমত জঙ্গল, পাহাড়, নদী, ঝরনা, সূর্যোদয়, সূর্যাস্ত ও মরুভূমির যে বিস্তীর্ণ দৃশ্যায়ন তা স্পিলবার্গের ছবিতে প্রক্ষিপ্ত হলেও বেমানান হবে না। সম্পূর্ণ ভাবে নারী চরিত্রবর্জিত একটি ছবিতে আমরা যে কোনও নায়িকার অভাববোধ করলাম না তার প্রধান কারণ প্রকৃতিরই রূপলাবণ্যের ধারাবাহিকতা। আর সেই প্রকৃতিই যখন সময় সময় তার ভীষণ রূপ ধারণ করে সে যে কী ভয়ঙ্কর সম্মোহনী তার নিপুণ ছবি অগ্ন্যুৎপাত ও ভূমিকম্পের সিকোয়েন্সে।
পাহাড়ের পিছনে: সিনেমাটোগ্রাফার সৌমিক হালদার ও পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়।
তবে ‘চাঁদের পাহাড়’য়ের প্রকৃত থ্রিল সিংহের স্টেশন আক্রমণ এবং শায়িত শঙ্করের ওপর মাম্বা সাপের চড়ে বসা। এবং অবশ্য বিভূতিভূষণ যাকে বলেছেন ‘এ স্পেসিস অব অ্যানথ্রোপয়েড এপ’, সেই বুনিপের সঙ্গে শঙ্করের মোকাবিলা। চমৎকার শিহরন হয় সেই দৃশ্যে যেখানে স্রোতস্বিনী পাহাড়ি নদীর কয়েক শ’ ফুট উপরে অবসন্ন আলভারেজকে কাঁধে চড়িয়ে শঙ্কর এ পাহাড় থেকে ও পাহাড় যায় একটা গাছের গুঁড়ির ওপর পা ফেলে ফেলে।
বড়রা তো বটেই, ছোটরাও প্রশ্ন তুলছে একটা সিংহের কয়েক গজ সামনে থেকে দৌড়ে কী করে শঙ্কর পার পায়? বিভূতিবাবুর লেখায় শঙ্কর যে নিঃশব্দে পিছু হটে হটে স্টেশনে ফিরল সেটা অনেক বিশ্বাসযোগ্য। কারণ এলিফ্যান্ট ঘাসে আচ্ছন্ন প্রান্তরে সিংহ ওকে দেখতেই পায়নি।
অবিশ্বাস্যকে বিশ্বাস করানোর জন্যই তো সিনেমা। সেই জন্যই তো ‘চাঁদের পাহাড়’ লেখা বা ছবি করা। সে ভাবেই তো দেবের মতো নায়ককে এত অপূর্ব এক চরিত্রে পাওয়া। শুনেছি এ ছবির জন্য উনি নাকি ফিজ নেননি। যদি সত্যি হয়, বেশ করেছেন। ফিজ উনি জীবনে অনেক পাবেন। কিন্তু এ ছবি আর পাবেন না। ন্যাড়া ক’বার বেলতলায় যায়? বাঙালি ক’বার ‘চাঁদের পাহাড়’ করে? এ তো ‘ধুম ১-২-৩’ নয়। নয় ‘চেন্নাই এক্সপ্রেস’ও।
অ্যালভারেজের চরিত্রে অভিনয়ে মাত করে রেখেছেন জেরার্ড রুডলফ। অসাধারণ অভিনয়, কী নানা ভাষার সংলাপে, কী চোখমুখের নীরব ব্যবহারে। বিদেশি চরিত্রেরা প্রায় সবাই নিটোল। কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায় এমন ভাবে ছবিটা ভেবেছেন ও গড়েছেন যেন এটাই তাঁর জীবনের শেষ কাজ। তা হলেও কোনও ক্ষতি নেই। একজন বাঙালি পরিচালকের জীবনের শেষ কাজ হওয়ার মতোই ছবি। আর এর পর আর একটা ছবিতে হাত না দিলেও আলোকচিত্রের আলোচনায় থেকে যাবেন সৌমিক হালদার। ছবির কথনছন্দের সঙ্গে সুন্দর মানিয়ে সম্পাদনা করেছেন রবিরঞ্জন মৈত্র। আর সৌমিকের মতোই ‘চাঁদের পাহাড়’কে অন্য স্তরে তুলে নিয়ে গিয়েছেন ইন্দ্রদীপ দাশগুপ্ত। আফ্রিকার সুর ও ছন্দকে বাঙালি করে কী প্রাণজুড়ানো নির্মাণ! দেবের সম্পূর্ণ যাত্রায় আগাগোড়া নানা পরিস্থিতিতে অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য ভাবে পরিবর্তিত হয়েছে মেক আপ। এর জন্যে মেকআপ আর্টিস্ট সোমনাথ কুণ্ডুকে সাধুবাদ জানাতেই হয়।
‘চাঁদের পাহাড়’ দেখে বড় একটা সুখ এটাই যে নতুন করে মনে পড়ল বেশ কিছু অ্যাডভেঞ্চার ছবি। ‘কিং সলোমনজ মাইন’, ‘শি’ ‘হ্যারি ব্ল্যাক অ্যান্ড দ্য টাইগার’, ‘স্ফিংস’ ইত্যাদি কিংবা ঐতিহাসিক ছবি ‘খার্তুম।’ ইন্দ্রিয়বিলাসের আয়োজনের সঙ্গে কাহিনির চরম পকড় যে সব ছবিতে। সে দিকটায় আলগা দেওয়াতে থ্রিলার ছবিটা একটু লম্বা ঠেকল। ফলে ৯ দিতে দিতেও সামলে নিতে হল।

ছবি: কৌশিক সরকার।



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.