পায়ের তলার সর্ষের মধ্যেই থাকে জীবনভর তাড়িয়ে বেড়ানো ভূত। সে জিভে মোচড় দিয়ে গল্পও বলায়। স্মরণীয় ভ্রামণিকেরা রবীন্দ্রনাথ থেকে উমাপ্রসাদ, বিভূতিভূষণ থেকে নবনীতা, পথের মোড়ক খুলে বার করে এনেছেন সরস কাহিনি। গল্প-বলা ভ্রামণিক আর উন্মুখ শ্রোতাদের এক দিন এক ছাদের নীচে জড়ো করার চেষ্টা হাল্কা চালেই হাতে নিয়েছিলেন ভদ্রেশ্বরের কিছু ভ্রমণমনস্ক মানুষ। দেখতে-দেখতে এ বার তার বয়স ষোলো হল। প্রতি ডিসেম্বরে তৃতীয় রবিবার বসে ‘ভ্রমণ আড্ডা’। গত ১৫ তারিখ আড্ডায় এসেছিলেন সাড়ে চারশোরও বেশি মানুষ। তার মধ্যে বেলুড়ের বিবেকানন্দ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্বামী আত্মপ্রিয়ানন্দ, নদী গবেষক কল্যাণ রুদ্র, সাহিত্যিক কমল চক্রবর্তী যেমন ছিলেন, ছিলেন বহু অনামা মানুষ যাঁরা ভ্রমণ অভিজ্ঞতায় অনন্য। এ বারের ‘মুসাফির’ সম্মান স্মারক পান জীবনভর মন্দির স্থাপত্য নিয়ে গবেষণা করে যাওয়া, বিরানব্বই বছরের শম্ভুনাথ মিত্র। ‘ভ্রমণ সম্মান’ পান রামকৃষ্ণ দাস। গত এক বছরে প্রকাশিত ভ্রমণ কাহিনির সুবাদে ‘কলম সম্মান’ পান রবীন চক্রবর্তী।
|
‘সমগ্র ভারতের হৃদয়ভূমি বঙ্গদেশ, বাংলার হৃদয়স্পন্দন ধ্বনিত হয় হুগলী জেলায়।’ শ্রীঅরবিন্দের কথাটা মনে রেখেই যেন বিজ্ঞানের ছাত্র সুধীরকুমার মিত্র নেমেছিলেন হুগলির ইতিহাস সন্ধানে। প্রথাগত অর্থে ইতিহাসের ছাত্র নন, তবু ইতিহাসের মুক্তি খুঁজেছিলেন তিনি। দলিল-দস্তাবেজ আর রাজ-নথির সীমায় আটকে না থেকে সমাজজীবন আর সাংস্কৃতিক পরিচয়ে হুগলি জেলাকে দেখতে চেয়ে প্রায় সাত দশক আগে তৈরি করেছিলেন দু’খণ্ডে ঐতিহাসিক একটি বই, হুগলী জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ। সুধীরকুমারের জন্মশতবর্ষে বহু ছবি ও টীকা-সহ সেই বইটির পুনঃপ্রকাশ ঘটল দে’জ পাবলিশিং থেকে। সম্পাদনা করেছেন সৌমিত্রশংকর সেনগুপ্ত ও পল্লব মিত্র।
|
বাংলার কীর্তনে খেতুরী যেন এক কৃতজ্ঞ দোহার। নরোত্তম দাসের পরিকল্পিত খেতুরী মহোৎসব আজ অনেকের কাছেই হারিয়ে যাওয়া এক উৎসব বলে মনে হয়। মুর্শিদাবাদ জেলার জিয়াগঞ্জের গাম্ভীলা শ্রীপাট আর ভগবানগোলার বুধরী শ্রীপাটে সে মেলা আজও ফি বছর হয়। তারই হালহকিকত আর ইতিহাসের সন্ধান নিয়ে সম্প্রতি প্রকাশিত হল জিয়াগঞ্জ কলেজের বাংলার অধ্যাপক শ্যামল রায়ের বই খেতুরী মেহাত্সব ও মেলা (ধ্রুবপদ প্রকাশনী)। মূল খেতুরী উৎসবের সন্ধানে বাংলাদেশের খেতুরী গ্রামেও গিয়েছেন শ্যামলবাবু। খোল, কর্তাল আর হারমোনিয়ামের মোটিফ দিয়ে বইটি সাজিয়েছেন বহরমপুরের শিল্পী কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত।
|
পাইড অ্যাভোসেট। পাকিস্তান সীমান্তে কচ্ছের রণে মাঝে মধ্যে দেখা মেলে এই পরিযায়ীদের। কচ্ছের বিস্তীর্ণ রণে ঘর বাঁধে তারা। তারপর প্রাক-গ্রীষ্মে ফের তারা উড়ে যায় মধ্য এশিয়া কিংবা আরও দূরে ইউরোপের প্রান্তে। সত্তরের দশকের শেষ দিকে বাংলার জলা-জঙ্গলেও বার কয়েক দেখা মিলেছিল দুধ সাদা ডানার এই পাখিদের। তবে ক্রমেই বাংলা-বিমুখ হয়ে গিয়েছিল তারা। সল্টলেকের নলবনে বত্রিশ বছর আগে শেষ বার শীতের অতিথি হয়ে এসেছিল এক জোড়া অ্যাভোসেট। তার পরে তারা আর এ-মুখো হয়নি। হারানো সেই অতিথিদের ফের দেখা মিলেছে সুন্দরবনের সাগর দ্বীপের কাছে একটি চরে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার’-এর হয়ে সুন্দরবন এলাকায় ম্যানগ্রোভের উপরে গবেষণা চালানোর সময়ে কলকাতার ‘নেচার এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ওয়াইল্ড লাইফ সোসাইটি’র গবেষকদের গত ২৫ নভেম্বর হঠাৎই নজরে পড়ে এক জোড়া পাইড অ্যাভোসেট। ওই সংগঠনের পক্ষে বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী জানান, দিন সাতেকের অনুসন্ধানের পরে হলদিয়া থেকে সাগর, বিভিন্ন চরে তাঁরা অন্তত ১১টি অ্যাভোসেটের দর্শন পেয়েছেন। ‘বোম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি’র পক্ষে জানানো হয়েছে এ এক অতি বিরল অভিজ্ঞতা। সঙ্গের ছবিটি বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরীর তোলা।
|
বলার বিষয় ছিল ‘প্রাকৃতিক বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানে নৈর্ব্যক্তিকতা’। বক্তা অমর্ত্য সেন। ‘দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় স্মৃতি বক্তৃতা ২০১৩’ এই বিষয়ে বলতে গিয়ে বিজ্ঞানী দীপঙ্কর চট্টোপাধ্যায় কেবল একটি নাম হয়েই থাকবেন তা কি হয়! তিনি যে ছিলেন অমর্ত্য সেনের বাল্যবন্ধু। ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত পড়েছিলেন অমর্ত্যর সঙ্গে। বিশ্বভারতী কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার ঠিক আগের বছর, ১৯৫১-য় ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় দীপঙ্কর হয়েছিলেন দ্বিতীয়, অমর্ত্য প্রথম। তখনও বিশ্বভারতী-র পরীক্ষা হত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে। শহর থেকে দূরের দুই বন্ধুর এই ফল সাড়া ফেলে দিয়েছিল কলকাতায়। তার পরে দুই বন্ধু চলে যান কলকাতায়, প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। “দীপঙ্কর গোড়া থেকেই নিশ্চিত ছিল পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়বে। আমি দোলাচলে ছিলাম, পদার্থবিদ্যা না অর্থনীতি,” বলছিলেন অমর্ত্য। বিশ্বভারতী পাঠচক্র-এর আয়োজনে ওই বক্তৃতায় বলতে এসে বার বার অমর্ত্য বলছিলেন প্রিয় বন্ধুর স্মৃতি, শান্তিনিকেতন আশ্রমের ভিতরের বাড়িতে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনার কথা। বলছিলেন, কী ভাবে সমাজবিজ্ঞানের ‘এথিকস’-এর কথা বলতেন দীপঙ্কর, সেই দৃষ্টিভঙ্গি কী ভাবে গভীরে চারিয়ে গিয়েছিল অমর্ত্য-র মধ্যে, দুর্ভিক্ষ নিয়ে কাজ করার সময়। প্রাণ-অপ্রাণের সীমান্ত থেকে এ ভাবেই যেন তর্কমুখর হয়ে উঠল দুই বন্ধুর ভাবনা ২১ ডিসেম্বর, শান্তিনিকেতনের লিপিকা সভাঘরে। |