দু’জনেই নীরব ছিলেন। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নীরবতা ভাঙলেন। দু’জনেই।
সোমবার সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতিকে চিঠি লিখেছিলেন প্রাক্তন বিচারপতি অশোক গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা যৌন হেনস্থার অভিযোগ খারিজ করে সুপ্রিম কোর্টের তদন্ত কমিটির এক্তিয়ার ও কর্মপদ্ধতি নিয়ে একাধিক প্রশ্ন তুলেছিলেন তিনি। অভিযোগকারিণীর বয়ান কী ভাবে অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল ইন্দিরা জয়সিংহ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করলেন, তা নিয়েও ক্ষোভ জানান।
মঙ্গলবার ফের ব্লগে আত্মপ্রকাশ করে অভিযোগকারিণী নিজের মতো করে বেশ কিছু প্রশ্নের জবাব দিলেন। অশোকবাবুর বিরুদ্ধে চক্রান্তের অভিযোগ অস্বীকার করে সুপ্রিম কোর্টের কমিটির তদন্ত-রিপোর্টের উপরেই সম্পূর্ণ আস্থা রাখছেন বলে জানালেন। কেন তিনি পুলিশের কাছে যাননি আর কেনই বা ইন্দিরাকে তাঁর বয়ান প্রকাশ করতে অনুরোধ করেছিলেন, দিয়েছেন তার ব্যাখ্যাও। “সংবাদপত্রে দেখলাম, সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি অশোককুমার গঙ্গোপাধ্যায় দেশের প্রধান বিচারপতিকে একটা চিঠি লিখেছেন। গত কয়েক সপ্তাহে গোটা বিষয়টি নিয়ে নানা প্রশ্নও উঠেছে। আমার মনে হয়, এ বার কিছু প্রশ্নের উত্তর দেওয়া দরকার,” লিখেছেন তিনি।
আগের দিন অশোকবাবু তাঁর চিঠিতে লিখেছিলেন তাঁর আশঙ্কা, কায়েমি স্বার্থে আঘাত লাগা প্রভাবশালী শিবিরের একাংশ তাঁকে হেনস্থা করার চক্রান্ত করেছে। সুপ্রিম কোর্টের তিন বিচারপতিকে নিয়ে গড়া তদন্ত কমিটি কোন এক্তিয়ারে প্রাক্তন বিচারপতির বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করল এবং সেই রিপোর্টের আইনি বৈধতাই বা কী, প্রশ্ন তোলেন অশোকবাবু। তিনি লেখেন, ওই মহিলা ইন্টার্ন নিজে থেকে অভিযোগ দায়ের করেননি। তদন্ত কমিটি তাঁকে ডেকে পাঠানোর পরই তিনি বয়ান দেন।
এ দিন অভিযোগকারিণী তাঁর ব্লগ-পোস্টে পাল্টা অভিযোগের সুরে লিখেছেন, “যাঁরা নানা রকম গুজব রটাচ্ছেন এবং বিষয়টায় রাজনীতির রং লাগাচ্ছেন, তাঁরা আসলে গোটা ব্যাপারটা গুলিয়ে দিতে চাইছেন। দায় এড়াতে চাইছেন।” কেন তিনি ঘটনার বেশ অনেক দিন পরে ব্লগ লিখলেন, কী ভাবে তদন্ত কমিটির সামনে হাজির হলেন, কেন ইন্দিরাকে তাঁর বয়ান প্রকাশ করতে বললেন, কেন তিনি পুলিশের কাছে যাচ্ছেন না নিজের বিরুদ্ধে ওঠা এই চারটি প্রশ্ন বেছে নিয়ে উত্তর দিয়েছেন অভিযোগকারিণী।
এ দিন ব্লগে মেয়েটি লিখেছেন, ওই ঘটনা ঘটার পরে তিনি কলকাতায় ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব জুরিডিক্যাল সায়েন্সেস-এ ফিরে এসেছিলেন। বিভিন্ন সময়ে বিভাগের কয়েক জন শিক্ষককে ঘটনাটা জানিয়েওছিলেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টার্নদের জন্য যৌন হেনস্থা সংক্রান্ত কোনও নীতি না থাকায় সেখান থেকে বিশেষ কার্যকরী পদক্ষেপের আশা ছিল না। অনেকেই পরামর্শ দিয়েছিলেন পুলিশের কাছে যাওয়ার। কিন্তু অভিযোগকারিণী তাতে খুব একটা আগ্রহী ছিলেন না। “কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল, নবীন ছাত্রছাত্রীদের সতর্ক করা দরকার। তারা যেন কারও পদমর্যাদা বা প্রভাব-প্রতিপত্তি দেখে ন্যায়নীতি বা মূল্যবোধের ব্যাপারটা গুলিয়ে না ফেলে। তাই ব্লগ লেখার সিদ্ধান্ত।”
বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর চিঠিতে সুপ্রিম কোর্টের কমিটির কর্মপদ্ধতি নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিলেন। অভিযোগকারিণী কিন্তু লিখেছেন, “বিষয়টির স্পর্শকাতরতার দিকটি মাথায় রেখে কমিটি অত্যন্ত বিবেচনার সঙ্গে এগিয়েছে। কমিটির প্রাথমিক রিপোর্টে কী পাওয়া গিয়েছে, তা এখন সকলেই জানেন।” কমিটির ভূমিকায় সন্তোষ প্রকাশ করে তাঁর বক্তব্য, তিনি কোনও সময়েই কমিটির এক্তিয়ার বা উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। “কমিটির উপরে আমার পূর্ণ আস্থা ছিল। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে আমি শুধু চেয়েছিলাম, প্রক্রিয়াটি গোপন থাকুক।”
অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল ইন্দিরা জয়সিংহ কী ভাবে গোপন বয়ান বিলি করলেন, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়। অশোকবাবুর দাবি, ইন্দিরা যে বয়ান প্রকাশ করেন, তাতে ২৯ নভেম্বর তারিখ ছিল। অথচ তার দু’দিন আগেই, ২৭ নভেম্বর তদন্ত কমিটি তার রিপোর্ট জমা দিয়ে দিয়েছিল। তা হলে অভিযোগকারিণী ২৯ তারিখ বয়ান দিলেন কী ভাবে? অভিযোগকারিণীর জবাব, “১৮ নভেম্বর কমিটির কাছে আমি ব্যক্তিগত ভাবে হাজির হয়ে মৌখিক বয়ান দিই। লিখিত বয়ানটিও তাঁদের সামনে সই করে জমা দিই। ২৯ নভেম্বর আমি সেই বয়নটিই একটি হলফনামার আকারে অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল ইন্দিরা জয়সিংহের কাছে পাঠাই।”
অশোকের প্রশ্নের উত্তরে আগের দিন ইন্দিরা বলেন, অভিযোগকারিণীর অনুরোধ মেনেই তিনি বয়ানটির প্রতিলিপি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ করেছিলেন। এ দিন অভিযোগকারিণীও একই কথা লিখেছেন ব্লগে। “কমিটির রিপোর্টের কিছু অংশ জানাজানি হওয়ার পর থেকেই বহু গণ্যমান্য মানুষ, যাঁদের মধ্যে আইন জগতেরও অনেকে রয়েছেন, তাঁরা নানা প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন এবং আমার সম্পর্কে কুৎসা রটাতে থাকেন। ওই পরিস্থিতিতে আমার মনে হয়েছিল, নিজের সম্ভ্রম এবং সুপ্রিম কোর্টের মর্যাদা রক্ষা করতে হলে আমার নিজের বয়ানের খুঁটিনাটি সম্পর্কে কিছু ব্যাখ্যা দেওয়া প্রয়োজন। সেই কারণে আমার বক্তব্য প্রকাশ্যে আনার ব্যাপারে অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল ইন্দিরা জয়সিংহকে দায়িত্ব দিয়েছিলাম।”
অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন, বিষয়টি নিয়ে এত হইচইয়ের পরেও অভিযোগকারিণী পুলিশের কাছে যাচ্ছেন না কেন। মেয়েটির বক্তব্য, “উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত পদক্ষেপ করার মতো বুদ্ধি আমার আছে। কখন কী করব, সেই ব্যাপারে আমার স্বাধীনতাটুকু যেন সম্মান করা হয়।”
অশোকবাবু অবশ্য অভিযোগকারিণীর এ দিনের ব্লগ নিয়ে কোনও কথাই বলতে চাননি। সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির কাছে চিঠি পাঠানোর পরে তাঁর পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে সে ব্যাপারেও মুখ খুলতে চাননি। তবে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহল আশা করছে অশোকবাবু যেহেতু কমিটি গড়ার প্রক্রিয়া নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন, প্রধান বিচারপতি ওই কমিটি বাতিল করে দিতেও পারেন। এর ফলে ওই কমিটির সিদ্ধান্তের আর কোনও ভিত্তি থাকবে না। যদি প্রধান বিচারপতির কাছ থেকে সাড়া না মেলে, ওই চিঠিটি নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে রিট আবেদনও করতে পারেন অশোক। এ ছাড়াও কারও কারও মতে, অশোক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে সংবিধানের ৩২ নম্বর ধারায় মামলা করতে পারেন। আবার সংবিধানের ২১ নম্বর অনুছেদ অনুযায়ী মর্যাদার অধিকারের প্রশ্নে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে মানহানি মামলাও করা যেতে পারে।
অশোকের চিঠির পরে কেন্দ্র কী ভাবছে? সরকারি ভাবে মন্তব্য না করলেও কেন্দ্রের অন্দরমহলের খবর, তারা ওই চিঠিকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে না। প্রাক্তন বিচারপতির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগগুলিকেই গুরুত্ব দিয়ে তাঁকে সরানোর প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে চাইছে তারা। প্রাক্তন সলিসিটর জেনারেল হরিশ সালভের মতে, চিঠি লিখে নিজের বিপদই বাড়ালেন অশোক। অভিযোগকারিণীর দিকে আঙুল তুলে তিনি সন্দেহ আরও উস্কে দিলেন। রাজ্যসভার বিরোধী দলনেতা অরুণ জেটলিও বলছেন, ‘‘সিজারের পত্নীর সব সময় সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকা উচিত। নৈতিকতার দায় নিয়ে সরে যাওয়াই উচিত অশোকের।”
|
চাপানউতোর |
অশোক গঙ্গোপাধ্যায় |
অভিযোগকারী মহিলা ইন্টার্ন |
• প্রাক্তন বিচারপতির বিরুদ্ধে তদন্ত করার এক্তিয়ার সুপ্রিম কোর্টের নেই। ওই কমিটির রিপোর্টের কোনও আইনি ভিত্তি নেই।
• অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেল অভিযোগকারিণীর বয়ানের প্রতিলিপি বিলি করেছেন বলে শুনেছি। আশা করি সংশ্লিষ্ট মহলের অনুমতি নিয়েই তিনি এ কাজ করেছেন।
• সুপ্রিম কোর্ট কমিটি গড়ার আগে ও পরে ওই ইন্টার্ন কোনও অভিযোগ দায়ের করেননি। কমিটির নির্দেশে তিনি তাঁর বয়ান দিয়েছেন। |
• বিষয়টির স্পর্শকাতরতা মনে রেখে কমিটি অত্যন্ত বিবেচনার সঙ্গে এগিয়েছে। প্রাথমিক রিপোর্ট কী বলছে, সকলে জানেন।
• ২৯ নভেম্বর আমি হলফনামা সই করে অতিরিক্ত সলিসিটর জেনারেলের কাছে পাঠাই। আমার বক্তব্য প্রকাশ্যে আনার ব্যাপারে ওঁকেই আমি দায়িত্ব দিয়েছিলাম।
• বিভাগের শিক্ষকদের জানিয়েছিলাম। তবে পুলিশের কাছে যেতে চাইনি। কিন্তু ক্রমশ মনে হচ্ছিল কমবয়সিদের এ বিষয়ে সতর্ক করা দরকার। |
|