পুরনো বিভেদ ভুলে বড়দিনে একাত্ম মীরপুর
মেলালেন ‘তিনি’ মেলালেন।
প্রায় আড়াইশো বছরের বিরোধিতার ইতিহাস মুছে গেল মিলনের সুরে। বড়দিন উপলক্ষে একাত্ম হয়ে গেল মহিষাদলের মীরপুরে বসবাসকারী পর্তুগিজ সম্প্রদায়ের প্রোটেস্ট্যান্ট ও রোমান ক্যাথলিকরা। প্রতি বারের মতো আলাদা মেলা না করে এ বার দুই গোষ্ঠী একসঙ্গে গঠন করেছে বড়দিন উৎসব কমিটি। প্রতি বারের মতোই এ বারও আট দিন ধরে চলবে মেলা, অনুষ্ঠান, হই-হুল্লোড়। শুধু বিভেদের প্রাচীরটা মুছে যাওয়ায় আনন্দ দ্বিগুণ।
কমিটির যুগ্ম সম্পাদক পদে দুই গোষ্ঠীরই এক জন করে রয়েছেন। কমিটির যুগ্ম সম্পাদক এডুয়ার্ড নবীন রথা ও স্বপন তেসরা বলেন, “মনে মনে আমরা দুই গোষ্ঠীর মিলন চাইলেও তা আর হয়ে উঠছিল না। এবারের বড়দিন আমাদের কাছে ঐক্যের।” আট দিন ব্যাপী এই উৎসবের উদ্বোধন করতে বুধবার মীরপুরে আসছেন সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী। তাঁর কথায়, “যিশুর বাণীর মর্মার্থ ওঁরা গ্রহণ করলেন, সেটাই সুখের। সকলেই এতে অনুপ্রাণিত হন। মানুষে মানুষে মৈত্রী ও প্রেম থাকলেই প্রকৃত মানব উন্নয়ন হবে।”
সেজে উঠছে মীরপুরের গির্জা। —নিজস্ব চিত্র।
হুগলি নদীর তীরে মহিষাদল ব্লকের গ্রাম বেতকুণ্ডু ও শুকলালপুর। এই দু’টি গ্রামের অংশবিশেষ নিয়ে রয়েছে খ্রিস্টান পাড়া মীরপুর। সেখানে প্রায় দেড়শো খ্রিস্টান পরিবারের বাস। এলাকায় রয়েছে দু’টি ‘চ্যাপল’। সেখানে নিয়মিত যিশুর উপাসনা চলে। প্রায় প্রতিটি বাড়ির উঠোনে তুলসি মঞ্চের আদলে রয়েছে যিশু ও মা মেরির ছোট মন্দির। ইতিহাসে পাওয়া যায়, অষ্টাদশ শতাব্দীতে বর্গী হামলার সময় মহিষাদলের রাণী জানকীদেবী এলাকাকে সুরক্ষিত রাখতে গোয়া (মতান্তরে ব্যান্ডেল) থেকে প্রায় ১২ জনের পর্তুগিজ জলদস্যু নিয়ে আসেন। ওই বারো জনকে থাকা-খাওয়ার জন্য তিনি মীরপুরে প্রায় একশো বিঘা জমি দান করেছিলেন। দীর্ঘ দিন ধরে সেখানে থাকার পর ধীরে ধীরে বাঙালি ভাষা, সংস্কৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে পড়েন ওই পর্তুগিজরা। বাঙালি মেয়ের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কের বন্ধনেও আবদ্ধ হন অনেক পর্তুগিজ। খ্রিস্টধর্মের বিভিন্ন অনুষঙ্গের পাশাপাশি তাঁরাও মেতে ওঠেন বাঙালির বারো মাসের তেরো পার্বণে।
মীরপুরে বসবাসকারী পর্তুগিজদের মধ্যে প্রোটেস্ট্যান্ট ও রোমান ক্যাথলিক উভয় গোষ্ঠীর মানুষই রয়েছেন। এতদিন প্রতি বছর বড়দিনে ওই দুই গোষ্ঠীর মানুষেরা পৃথক ভাবে মেলার আয়োজন করত। তাই পাশাপাশি থেকেও বড়দিনের উৎসব ঘিরে ছিল এক বিভেদের প্রাচীর। এই বছর ওই দুই গোষ্ঠী মিলে একটিই মেলা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। একসাথে মেলা হওয়ায় স্থানীয় কিশোর-কিশোরী দীপ লবু, সুমনা পেরেরা আনন্দে উচ্ছ্বল। স্থানীয় বাসিন্দা রনি রথা বলে, “আগে মেলায় দু’টি পৃথক অনুষ্ঠান হত বলে উৎসবের দিনেও আমাদের সমবয়সীদের আনন্দটাই মাটি হত। এ বার একসাথে মেলা হওয়ায় বেশি আনন্দ হচ্ছে।” প্রাথমিক শিক্ষিকা শোভা তেসরা, সুজাতা বিশ্বাস রথারা বলেন, “আগে দু’টো আলাদা অনুষ্ঠানে দু’পক্ষের প্রতিযোগিতা ও পারস্পরিক বিরোধিতায় বাইরে থেকে আসা মানুষেরা বিভ্রান্ত হতেন। এই বিরোধিতার কারণে অনেক প্রখ্যাত ব্যাক্তিরাও অনুষ্ঠানে আসতেন না।”
মেলা উপলক্ষে মীরপুরে ব্যস্ততা তুঙ্গে। মীরপুরের একটি গির্জার সিস্টার সরলা বলেন, “বড়দিনের ঠিক আগের রবিবার থেকেই আমাদের অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি শুরু হয়। মেলার বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় শুধু খ্রিস্টানরা নন, অন্য ধর্মের ছেলেমেয়েরাও অংশগ্রহণ করে।” কমিটির পক্ষ থেকে তৈরি করা হয়েছে একাধিক তোরণ। রঙিন আলোর মালায় আলোকময় রাস্তার দু’দিক। মেলার অনুষ্ঠানে নাচ, গান, অভিনয়-সহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজনও থাকছে। বড়দিনের উৎসব উপলক্ষে কর্মসূত্রে বাইরে থাকা অনেকেই বাড়ি ফিরেছেন। মীরপুরের বাসিন্দা মিন্টু তেসরা, অনিমা তেসরারা কর্মসূত্রে কলকাতায় থাকেন। বড়দিন পালন করতে সপরিবারে তাঁরা গ্রামে ফিরেছেন। মিন্টু তেসরার কথায়, “কলকাতায় বড়দিনের উৎসব দু’এক দিনের। কিন্তু মীরপুরে আট দিনের নানা কর্মসূচি নিয়ে মেলা বসে। যাত্রা, নাটক, গান হয়। কলকাতা থেকেও অনেকে মেলায় আসেন।”
বড়দিনের মেলা উপলক্ষে এলাকার বাড়িগুলি আলো, ফুল, বেলুন দিয়ে সাজানো হয়। তৈরি করা হয় গোশালা। স্থানীয় বাসিন্দা মলয় তেসরা বলেন, “বড়দিনে এলাকার সব ঘরবাড়ি সাজিয়ে তোলা হয়। অতিথি আপ্যায়নের ব্যবস্থাও থাকে। বাড়িতেই তৈরি হয় কেক।” শুকলালপুরের পঞ্চায়েত সদস্য শেখ আজিজুল ও বেতকুণ্ডুর পঞ্চায়েত সদস্য কালিকিঙ্কর দাসও উৎসব কমিটিতে রয়েছেন। শেখ আজিজুলের কথায়, “বড়দিনকে কেন্দ্র করে এমন সম্প্রীতির উৎসব অন্য কোথাও দেখা যায় না।” পূর্ব মেদিনীপুরের জেলাশাসক অন্তরা আচার্য বলেন, “মিলনই উৎসবের মুখ্য বিষয়। হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টানরা সমবেতভাবে মীরপুরের উৎসবে বরাবরই সামিল হন। এ বারের বড়দিন আরও বেশি আনন্দের হয়ে উঠবে।”
মেলার প্রতিদিন সকালে খোল-হারমোনিয়াম সহযোগে বাড়ি বাড়ি যান খ্রিস্টান কীর্তনীয়ার দল। তাঁদের মুখে-মুখে ছড়িয়ে পড়ে যিশু বন্দনার গান“করুণা করি এমরু ভুবনে। এসেছ আজি পুণ্য লগনে। তব আগমনি গান গাহে দূত গনে। শান্তির বাণী প্রচারে।”


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.