স্রেফ ফ্রিজের অভাবে সংগৃহীত হওয়া প্লাজমা বা রক্তরস ফেলে দেওয়া হচ্ছে বলে গুরুতর অভিযোগ উঠেছে পূর্ব ভারতের ‘মডেল ব্লাড ব্যাঙ্ক’ হিসেবে চিহ্নিত মানিকতলা কেন্দ্রীয় ব্লাড ব্যাঙ্কে। গত বৃহস্পতিবার থেকে চলছে এই অবস্থা।
বৃহস্পতিবার থেকে সোমবার এই পাঁচ দিন ফেলে দেওয়া প্লাজমার পরিমাণ এক হাজার ইউনিটেরও বেশি! স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর, বৃহস্পতিবার অর্থাৎ ১৯ ডিসেম্বর ১৭০ ইউনিট, ২০ তারিখ ১৫০ ইউনিট, ২১ তারিখ ১৫০ ইউনিট, ২২ তারিখ ১৭০ ইউনিট, ২৩ তারিখ ৪০০ ইউনিট প্লাজমা ফেলা হয়েছে। অর্থাৎ, সব মিলিয়ে ১০৪০ ইউনিট প্লাজমা নষ্ট হয়েছে। বেসরকারি কোনও ব্লাড ব্যাঙ্ক থেকে কিনতে গেলে এর এক-একটি ইউনিটের দাম ৪০০ থেকে ৭০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
মানিকতলা ব্লাড ব্যাঙ্কের অধিকর্তা সৌরীন্দ্রনাথ গুছাইত প্লাজমা ফেলে দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, “প্লাজমা ফেলে দেওয়া ছাড়া আমাদের কোনও উপায় ছিল না। আমাদের মাইনাস ৪০ ডিগ্রির দু’টি ফ্রিজ এবং মাইনাস ৮০ ডিগ্রির দু’টি ফ্রিজ কাজ করছে। তাতে রক্তরস ছাড়াও রক্তের বিভিন্ন উপাদান ও ‘হোল ব্লাড’ রাখা হয়। আরও দু’টি মাইনাস ৪০ ডিগ্রির ফ্রিজ গত দেড় বছর ধরে খারাপ হয়ে রয়েছে। জায়গার সঙ্কুলান হচ্ছে না।”
সৌরীন্দ্রনাথবাবু আরও বলেন, “প্লাজমা এক বার সংগ্রহের পরে প্রায় এক বছর পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়। শীতকালে এমনিতে রক্তদান শিবির বেশি হয়। ফলে রক্তরস সংগ্রহের পরিমাণও বাড়ে। সেই পরিমান প্লাজমা খরচ হয় না। এত প্লাজমা রাখব কোথায়? ফলে যে সব প্লাজমা বেশ কিছু দিন ধরে জমানো আছে, সেগুলি ধরে ধরে ফেলে দিয়ে অপেক্ষাকৃত নতুন প্লাজমা সেখানে রাখছি। অবিলম্বে আমাদের অন্তত চারটি ফ্রিজ লাগবে। তবেই প্লাজমা জমানো যাবে।” |
কিন্তু ফ্রিজ সারাই না করলে বা নতুন ফ্রিজ না কিনলে যে এই হারে প্লাজমা ফেলে দিতে হবে, সে কথা কি স্বাস্থ্য ভবনে জানানো হয়নি? সৌরীন্দ্রনাথবাবুর উত্তর, “দশ দিন আগে রাজ্যের স্বাস্থ্য-অধিকর্তা বিশ্বরঞ্জন শতপথী এবং রাজ্য এড্স নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ সংস্থার প্রকল্প অধিকর্তা উৎপল চট্টোপাধ্যায়কে চিঠি দিয়ে সব জানিয়েছি। এর পরেও যদি কোনও ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, আমি কী করব?” উৎপলবাবু এ ব্যাপারে কিছু বলতে না-চাইলেও বিশ্বরঞ্জন শতপথী উত্তর দেন, “দশ দিন আগে কোনও চিঠি পাইনি। আমি মানিকতলা ব্লাড ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। ওঁরা আমায় বললেন, পরশু দিন থেকে প্লাজমা ফেলে দিচ্ছেন আর পরশু দিনই নাকি আমাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন! বিষয়টি আমার কাছে দুর্বোধ্য ঠেকছে। আমি এ বিষয়ে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছি।”
প্রসঙ্গত, ঠিক এক বছর আগে ২০১২ সালের অক্টোবর-নভেম্বরে হুবহু একই ঘটনা ঘটেছিল মানিকতলা ব্লাড ব্যাঙ্কে। সেই সময়ে ফ্রিজের অভাবে ২৮ অক্টোবর থেকে ১৪ নভেম্বর পর্যন্ত ১৮ দিনে ফেলে দেওয়া প্লাজমার পরিমাণ ছিল প্রায় ২৩৬০ ইউনিট। তখন বিষয়টি নিয়ে হইচই হওয়ার কয়েক দিনের মধ্যেই ফ্রিজের ব্যবস্থা করা হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন স্বাস্থ্যকর্তারা। মানিকতলার টেকনিশিয়ানদের একাংশের ক্ষোভ, স্বাস্থ্যক্ষেত্রে এত লক্ষ-লক্ষ টাকা খরচ হচ্ছে অথচ স্বাস্থ্য দফতরের উদাসীনতায় দু’-তিনটে ফ্রিজের ব্যবস্থা দেড় বছরেও হল না। ফলে এখনও এত পরিমাণ প্লাজমা ফেলে দিতে হচ্ছে।
প্লাজমা অতিরিক্ত হয়ে থাকলে সংগৃহীত রক্ত থেকে প্লাজমা উৎপাদন বন্ধ রাখা হচ্ছে না কেন? ব্লাড ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের যুক্তি, “জাতীয় এড্স নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (ন্যাকো) কড়া নির্দেশ, প্রতিদিন যত রক্ত সংগ্রহ হবে, তার ৮০ শতাংশ থেকে আমাদের প্লাজমা ও রক্তের অন্যান্য উপাদান তৈরি করতেই হবে।” উল্লেখ্য, সিরোসিস অব লিভারের রোগী থেকে অগ্নিদগ্ধ রোগী, স্নায়ুরোগে আক্রান্ত মানুষ, সাপে কামড়ানো রোগী থেকে হিমোফিলিয়ার রোগী প্রত্যেকেরই বাঁচার জন্য প্লাজমা দরকার হয়।
মানিকতলা ব্লাড ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, এই সময়ে তাঁদের ব্লাড ব্যাঙ্ক সপ্তাহে ১০-১২টা করে রক্তদান শিবির থেকে রক্ত সংগ্রহ করছে। সংগৃহীত রক্ত থেকে প্রতিদিন ৮০-১০০ ইউনিট প্লাজমা তৈরি হচ্ছে। এগুলি সঞ্চয় করে রাখলে গ্রীষ্মে রক্তসঙ্কটের সময় মানুষ অসম্ভব উপকৃত হতেন। কারণ, গ্রীষ্ম-বর্ষায় সাপে কামড়ানোর ঘটনা বা লিভারের রোগের হার অনেক বেশি অথচ তখন রক্তদান শিবির কম হয়। কিন্তু জায়গার অভাবে উল্টে প্লাজমা ফেলতে হচ্ছে।
প্রশ্ন উঠেছে, তা হলে কেন স্বাস্থ্য দফতর রক্তের উপাদান প্রস্তুতকারী কোনও সরকারি বা বেসরকারি সংস্থাকে অতিরিক্ত প্লাজমা বিক্রি করে আয় বাড়ানোর চেষ্টা করছে না? রক্তনিরাপত্তা বিভাগের এক কর্তার উত্তর, “এই রকম একটা বিনিময়-ব্যবসায় ঢোকার পরিকল্পনা রয়েছে। প্লাজমার বিনিময়ে রক্তের ব্যাগ বা ইমিউনোগ্লোবিউলিন আনানো যেতে পারে। তবে তার জন্য অনেকটা দীর্ঘ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। দরপত্র ডাকতে হবে। সময় লাগবে।” |