এই সেই কৃত্রিম হৃদযন্ত্র।
দিব্যি চলছিল সে। আচমকাই ছন্দপতন আর তার পর এক দিন বিকল হয়ে যাওয়া। হৃদযন্ত্রের এমন পরিণতিতে ফি বছর বহু মানুষ মারা যান। এমনটা হতে পারত ফ্রান্সের পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধের সঙ্গেও। কিন্তু সম্প্রতি তাঁর দেহে কৃত্রিম হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন করেছে ফ্রান্সের এক দল চিকিৎসক। এবং তাঁদের দাবি, চিকিৎসাবিজ্ঞানের ইতিহাসে এটিই প্রথম সফল কৃত্রিম হৃদযন্ত্র্র প্রতিস্থাপন।
তবে একই সঙ্গে সতর্কবাণী শুনিয়েছেন প্যারিসের ‘জর্জ পম্পিদো হসপিটাল’-এর ডাক্তাররা। তাঁদের মতে, গত বুধবারই বৃদ্ধের দেহে কৃত্রিম হৃদযন্ত্র্র প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। তার পর মাত্র তিন দিন কেটেছে। কৃত্রিম হৃদযন্ত্র্রের উপস্থিতি শরীরে কোনও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে কি না, তা মাত্র তিন দিনের পর্যবেক্ষণে স্পষ্ট ভাবে বোঝা সম্ভব নয় বলেই মত তাঁদের। এ জন্য রোগীকে অন্তত এক মাস পর্যবেক্ষণ করা দরকার। তবেই কোনও পাকাপাকি সিদ্ধান্তে পৌঁছনো সম্ভব হবে। কিন্তু তা হলে তার আগেই কী করে এই প্রতিস্থাপন সফল বলে ঘোষণা করছেন তাঁরা? ডাক্তারদের যুক্তি, অস্ত্রোপচারের পর রোগী স্বাভাবিক ভাবে কথা বলেছেন। এমনকী, মোটামুটি সুস্থও রয়েছেন। এই সব দেখেই প্রাথমিক ভাবে সাফল্যের দাবি তুলেছেন তাঁরা। |
কিন্তু এই কৃত্রিম হৃদযন্ত্র্রের মেয়াদ ঠিক কত দিন? যে বেসরকারি সংস্থা যন্ত্রটি বানিয়েছে, তাদের মতে, ব্যবহারকারীর আয়ু অন্তত পাঁচ বছর বাড়াতে সক্ষম এই যন্ত্র। তাঁদের আরও দাবি, এখনও পর্যন্ত যে ধরনের কৃত্রিম হৃদযন্ত্র্র বানানো হয়েছে গঠনগত ভাবে সেই তুলনায় তাঁদের তৈরি যন্ত্র উন্নতমানের। তার মূল কারণ, যন্ত্রের যে অংশটি শরীরের ভিতরে থেকে রক্তপ্রবাহের গতি নিয়ন্ত্রণ করবে, সেই অংশটি প্লাস্টিকের বদলে আসল হৃদযন্ত্র্রের পেশী (বোভাইন টিস্যু) দিয়ে তৈরি। আগন্তুক যন্ত্রটির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে শরীরের যাতে কোনও অসুবিধা না হয় সে জন্যই এই ব্যবস্থা। তা ছাড়া, দেহের প্রয়োজনীয়তা অনুযায়ী যন্ত্রে চার্জ দেওয়ার জন্য রয়েছে ব্যাটারির ব্যবস্থাও। ওই বৃদ্ধের শল্যচিকিৎসক অ্যালাইন কারপেনটিয়ারের বয়ানে, “ওষুধ ছাড়াই যাতে স্বাভাবিক সামাজিক জীবন কাটাতে পারেন রোগী, সে জন্যই এই ব্যবস্থা।”
তবে সমস্যা একটাই। আর তা হল ওজন। এই নয়া যন্ত্রটির ওজন ২ পাউন্ড। যা কি না আসল হৃদযন্ত্র্রের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বেশি। তা ছাড়া, আয়তনেও এটি আসল হৃদযন্ত্র্রের তুলনায় বড়। সব মিলিয়ে মানুষের দেহে এই যন্ত্র বসানোর উপযুক্ত জায়গা খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর। পুরুষের শরীরে যদি বা এটিকে বসানো যায়, মহিলাদের দেহে এর জায়গা হওয়া প্রায় অসম্ভব। নির্মাতা সংস্থাটি অবশ্য এই অভিযোগ মানতে নারাজ। তাঁদের দাবি, পুরুষের দেহে যদি সাফল্য মেলে, তা হলে তাঁরা মহিলাদের শরীরের উপযুক্ত কৃত্রিম হৃদযন্ত্র্রও বানিয়ে ফেলবেন। কিন্তু সে জন্য দরকার আরও পরীক্ষা।
তবে দেশের চিকিৎসকদের এই প্রাথমিক সাফল্যেই উচ্ছ্বসিত ফ্রান্সের স্বাস্থ্যমন্ত্রী মারিজল তুরোঁ বলেছেন, “এটাই বুঝিয়ে দিল আমরাও আবিষ্কার করতে পারি, এমন আবিষ্কার যা কি না বহু মানুষের কাছে আশার বার্তা নিয়ে আসতে পারে।” উৎসাহী সরকার আরও পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানোর জন্য গত সেপ্টেম্বরেই অনুমতি দিয়েছে ওই সংস্থাকে। এর ফলে তিনটি হাসপাতালের চার জন রোগীর শরীরে তাঁরা কৃত্রিম হৃদযন্ত্র্র প্রতিস্থাপন করতে পারবেন। তার পর এক মাস ধরে চলবে পর্যবেক্ষণ। এই পর্যায়ের পরীক্ষা-নিরীক্ষা অবশ্য আগামী বছরের মধ্যেই শেষ করতে চায় সংস্থাটি। আর তার পর ২০১৫ সালের মধ্যে গোটা ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে যন্ত্রটি নিয়ে আসতে চান তারা। দাম পড়বে প্রায় ১২ কোটি থেকে ১৫ কোটি টাকার মধ্যে।
অর্থাৎ পাশ্চাত্য দেশগুলির আমজনতার পক্ষেও সে চিকিৎসা বেশ ব্যয়বহুল। তবে অকাল মৃত্যুর কবল থেকে বেঁচে ফিরতে এমন মূল্য দিতে যে অনেকেই রাজি থাকবেন, সে রকম আশাই করছেন সংস্থার মালিকরা। |