রাতে খাওয়া-দাওয়া সেরে বাড়ির পথ ধরেছিলেন পারিবারিক বন্ধু। মাঝ রাতে ফিরে এসে হামলা চালানোর অভিযোগ উঠল তাঁরই বিরুদ্ধে। ছুরির কোপে মৃত্যু হল এক জনের। জখম আরও চার জন। কালনার তৈপাড়া গ্রামে এই তাণ্ডবের পরে রাত পোহালে অভিযুক্ত যুবকেরও ঝুলন্ত দেহ মিলল আমবাগানে।
পুলিশ জানায়, শনিবার রাতে কালনা শহর থেকে প্রায় পনেরো কিলোমিটার দূরে বেগপুর পঞ্চায়েতের চারাবাগান এলাকার যুবক, পেশায় দর্জি হারুন শেখ (৩৫) দু’কিলোমিটার দূরে তৈপাড়া গ্রামে বাগ পরিবারের সদস্যদের উপরে চড়াও হন বলে অভিযোগ। নিহত হন ওই বাড়ির ছোট ছেলে মুকুন্দ বাগ (২৬)। মুকুন্দর দুই দাদা, এক খুড়তুতো বোন ও তাঁর ছেলে জখম হন। সকালে আম গাছে হারুনের ঝুলন্ত দেহ মেলে। ঘটনার কারণ নিয়ে ধন্দে পুলিশ। |
পরিবার ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বাগ পরিবারের বড় বধূ মনিমালাদেবী বাড়িতে সেলাইয়ের নানা কাজ করেন। সেই সূত্রে বছরখানেক ধরে বুলবুলিতলা বাজারের দর্জি হারুনের তাঁদের বাড়িতে যাতায়াত ছিল। মনিমালাদেবীর স্বামী, রাস্তা তৈরির ঠিকা সংস্থার কর্মী সনৎবাবুর সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মাস দেড়েক আগে হারুনের ক্যানসার আক্রান্ত স্ত্রীর মৃত্যু হয়। তার পর থেকে তাঁর ছেলেমেয়ে মামারবাড়িতে রয়েছে। বাগ পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, শনিবার দুপুরে হারুন রান্না চাপাতে পারেননি জানালে তাঁকে তাঁদের বাড়িতেই খেতে বলা হয়। এর পরে রাতের আহারও তাঁদের সঙ্গেই সারতে চান হারুন। সনৎবাবুরা আপত্তি করেননি। রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ খাওয়া সেরে বাড়ির দিকে রওনা হন হারুন।
রাতে সনৎবাবুর ঘরের সামনের বারান্দায় মশারি টাঙিয়ে শুয়েছিলেন মেজো ভাই অমল। সনৎবাবুদের অভিযোগ, রাত ১টা নাগাদ হারুন ফিরে আসেন। প্রথমে মশারি তুলে ইট দিয়ে অমলবাবুর মাথায় মারেন। তাঁদের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে যায়। হারুন বাইরে থেকে সনৎবাবুর ঘরের দরজার শিকল তুলে দেন। অমলবাবু কোনও রকমে তা খুলে দিলে সনৎবাবু বাইরে বেরোন। অভিযোগ, হারুন তাঁর মুখে, ঘাড়ে এলোপাথাড়ি ছুরি চালাতে থাকে। চিৎকার শুনে আশপাশের ঘর থেকে বাড়ির অন্যেরা বেরিয়ে আসেন। ছোট ভাই মুকুন্দ হারুনকে তাড়া করে জাপটে ধরে ফেললে ছুরি দিয়ে তাঁকে এলোপাথাড়ি কোপানো হয়। এর পরে ছুটে পালানোর সময়ে হারুন সনৎবাবুর খুড়তুতো বোন প্রণতি মণ্ডল ও তাঁর ছেলে তন্ময়কেও ছুরি দিয়ে আঘাত করেন বলে অভিযোগ। যাওয়ার আগে বাড়ির মধ্যে মোবাইল ফোন ও বাইরে সাইকেল ফেলে রেখে যান হারুন।
রাতেই কালনা মহকুমা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে মুকুন্দকে মৃত বলে জানানো হয়। অমলবাবুকে পাঠানো হয় বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, ঘটনার পর থেকেই এলাকাবাসী হারুনের খোঁজে তল্লাশি শুরু করেন। সকালে তাঁর বাড়ির কাছেই একটি আমবাগানে ঝুলন্ত দেহ মেলে। কাছেই পড়েছিল একটি ছুরি ও গ্লাভ্স। এলাকাবাসীর দাবি, কাছাকাছি একটি আলু খেতের কাদা মাটিতে ‘আমার সম্পত্তি মা নয়, বৌদি মালিক’ এবং ‘আমার ঘটনা সব মোবাইলে লোড করা রয়েছে’, এই দু’টি লাইন ও নীচে হারুনের নাম লেখা ছিল।
এ দিন সকালে তৈপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, সনৎবাবুদের বাড়ি ঘিরে স্থানীয় মানুষজনের জটলা। খড়ের ছাউনির পাশাপাশি দু’টি মাটির বাড়ির বারান্দা, উঠোন, সিঁড়ি-সহ নানা জায়গায় রক্ত জমে। ছোট ছেলে মুকুন্দর মৃত্যুতে বাক্রুদ্ধ বৃ্দ্ধা মা শেফালীদেবী। সনৎবাবুর মুখে ব্যান্ডেজ বাঁধা। তিনি বলেন, “রাতে যে ভাল ভাবে খাওয়া-দাওয়া করল, সে এমন কাণ্ড ঘটাবে, স্বপ্নেও ভাবিনি। কেন হারুন এমন করল, মেলাতে পারছি না।” বাগ পরিবারের সদস্য ও গ্রামবাসীদের সন্দেহ, খাওয়া শেষ করে রাতে হারুন আর বাড়ি ফেরেননি, আশপাশেই কোথাও লুকিয়ে ছিলেন।
হারুনের দেহের ময়না-তদন্ত এ দিন হয়ে গেলেও দুপুর ২টো বেজে যাওয়ায় কালনা মহকুমা হাসপাতালের তরফে মুকুন্দর দেহ বর্ধমান মেডিক্যালে পাঠানো হবে জানালে ক্ষোভ-বিক্ষোভ শুরু হয়ে যায়। মৃতের পরিজনেরা ও তৈপাড়া গ্রামের মানুষজন এই হাসপাতালেই ময়না-তদন্তের দাবি জানিয়ে লাগোয়া রাস্তা অবরোধ করেন। বুলবুলিতলা এলাকাতেও পথ অবরোধ করা হয়। শেষে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ময়না-তদন্তের আশ্বাস দিলে প্রায় আড়াই ঘণ্টা পরে অবরোধ উঠে যায়। পুলিশ জানায়, হারুনের মোবাইলটি উদ্ধার করা হয়েছে। কালনার এসডিপিও ইন্দ্রজিৎ সরকার বলেন, “কেন এমন ঘটনা, সে ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত নয়। এর পিছনে বিবাহ বহির্ভূত কোনও সম্পর্কের জের রয়েছে কি না, খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মোবাইল থেকে কোনও সূত্র মেলে কি না, তার চেষ্টা চলছে।” |