|
|
|
|
কলকাতার বুকে নগ্ন ওথেলো |
পয়লা জানুয়ারি। কলকাতার মঞ্চ। সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে এক বাঙালি অভিনেতা এই প্রথম কোনও বাংলা
নাটকে আসবেন দর্শকের সামনে। রবিবার সকালে মিনার্ভা থিয়েটারে সেই মহড়া দেখে এলেন প্রিয়াঙ্কা দাশগুপ্ত। |
হাতটা থর থর করে কাঁপতে থাকে।
কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
মিনার্ভা রেপার্টোরি থিয়েটারের গ্রিনরুমে তখন চাপা নিস্তব্ধতা।
তার দশ মিনিট আগে শেষ হয়েছে মনীশ মিত্রের নতুন নাটকের মহড়া। যেখানে প্রথম বার কোনও বাঙালি অভিনেতা নিজেকে সম্পূর্ণ বিবস্ত্র করে অভিনয় করেছেন।
নাটকের নাম ‘শেক্সপিয়র’স ট্র্যাজিক হিরোস: ওথেলো, ম্যাকবেথ, হ্যামলেট...’ দলের নাম অর্ঘ। সেই নাটকের শেষ দৃশ্যে ওথেলো সম্পূর্ণ বিবস্ত্র। দেখানো হচ্ছে কী ভাবে ডেসডিমোনার সঙ্গে সঙ্গম করে তার পর তাকে খুন করছে ওথেলো। নাটকে ওথেলোর ভূমিকায় রয়েছেন তাপস চট্টোপাধ্যায়। ডেসডিমোনার চরিত্রে নেদারল্যান্ডের অভিনেত্রী নোয়া নার্নবার্গ।
কেন এমন একটা সিদ্ধান্ত নিলেন পরিচালক?
চুম্বনের দৃশ্য বাংলার মঞ্চে নতুন নয়। কিন্তু এ ভাবে কোনও অভিনেতাকে এতটা সাহসী কোনও নাটকের দৃশ্যে দেখা যায়নি। কলকাতার দর্শক দেখেছে সাবিত্রীদেবী অভিনীত ‘দ্রৌপদী।’ মণিপুরের এই অভিনেত্রী ২০০০ সাল থেকে এই নাটক করে আসছেন। যাঁরা দেখেছেন এই নাটক তাঁরা বলেন যে সাবিত্রীদেবী শরীর থেকে তাঁর কাপড়টা যখন সরিয়ে দেন তখন মনে হয় যেন এক কবিতা সৃষ্টি হল। এমন এক কবিতা যা জীবন থেকে উঠে আসে।
কিন্তু তাপস?
বয়স মাত্র তিরিশ। কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ে গত বছর ইতিহাস নিয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি পেয়েছেন। বারো বছর হল থিয়েটার করছেন। তবে এই রকম সাহসী চরিত্র এর আগে কোনও দিন করেননি।
|
|
ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল। |
তিন মাস ভাত খাওয়া বন্ধ। কেরল থেকে আনা একটা গাছের তেল দিয়ে গা মালিশ করা হয় তাঁর জন্য। দরজা বন্ধ করে প্রায় সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে মালিশ করা হয়। আর অভিনয়ের শেষে হিমশীতল বরফ গলা জলে স্নান করাটা জরুরি। তা না হলে ওই রকম একটা ‘ইনটেন্স’ দৃশ্যে অভিনয় করা প্রায় অসম্ভব।
প্রথম যে দিন এই দৃশ্যে অভিনয় করেন তাপস, সে দিন কার্টেন কলের সময় মঞ্চে আসতে পারেননি। নিজেকে প্রশ্ন করেননি এত বার ওথেলো মঞ্চে হওয়ার পরেও কেন কেউ কোনও দিন কলকাতাতে এ ভাবে নাটকটাকে ব্যাখ্যা করেননি? সে প্রশ্ন যে মাথায় আসেনি তা নয়। উত্তরে মনীশ বলছেন, “অনেকের মনে হতে পারে কেন এত শরীর এসে গেল এই নাটকে? দেখুন অয়দিপউসের ক্ষেত্রে ওর সত্যি তেমন কিছু করার ছিল না। কারণ, নিয়তিকে মেনে নিতে হয়েছিল। কিন্তু শেক্সপিরীয় ট্র্যাজেডির ক্ষেত্রে যে চরিত্রগুলোর কথা বলা হয় তারা অনেকাংশে নিজেরাই ট্র্যাজেডির জন্য দায়ী। এবং হয়তো তাদের ট্র্যাজেডিটা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। যেহেতু রক্তমাংসের মানুষের ভূমিকাটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে তাই শরীরটাও গুরুত্বপূর্ণ। মাংস গুরুত্বপূর্ণ। পেশি গুরুত্বপূর্ণ।” শুধু যে ওথেলোর ক্ষেত্রেই শরীর ব্যবহার করা হয়েছে এই প্রোডাকাশনে তা নয়। “লেডি ম্যাকবেথের ক্ষেত্রেও ফিজিক্যালিটিটা দেখানো হয়েছে। সেখানে একটা ‘ভাইটাল’ সংলাপও আছে। ‘কাম আনসেক্স মি’। তবে হ্যামলেটের ক্ষেত্রে শরীরের অংশ কম। ওফেলিয়ার প্রতি হ্যামলেটের প্রেমটা একদম অন্য ধরনের। সেখানে আমি কোনও ফিজিক্যালিটি রাখিনি। ‘ওথেলো’র ক্ষেত্রে নগ্নতা ব্যবহার করেছি যন্ত্রণার কাব্য রচনা করতে,” বলছিলেন পরিচালক।
তবে এই রকম একটা দৃশ্য ভাবতে গিয়ে কোনও ভয় কাজ করেনি? কল শো পাওয়া যাবে কি না? কলকাতার দর্শক যদি রে-রে করে আসে? কোনওটাই নাকি সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়নি মণীশের নাট্যদলের কাছে। ১১ ডিসেম্বর অ্যাকাডেমিতে একটা শো হয়ে গিয়েছে। সেখানে অবশ্য তাপস দর্শকের দিকে পিছন ঘুরে দাঁড়িয়ে অভিনয় করেছেন। তবে পরবর্তী শোগুলোতে অন্য রকম ভাবে অভিনয় করবেন তিনি। ফুল ফ্রন্টাল নুডিটি থাকবে সেখানে। সে অর্থে নাকি ১ জানুয়ারিতে গিরিশ মঞ্চের শো-টাই হবে প্রথম শো। তার পর আবার অ্যাকাডেমিতে, ৯ জানুয়ারি।
|
|
নাটকের ‘ম্যাকবেথ’ অংশে
প্রীতম চক্রবর্তী ও মেরি আচার্য। |
মহড়া দেখতে গিয়ে অবশ্য এই দৃশ্যটিকে আপাতত রুচিশীলই মনে হয়েছে। চন্দন দাসের আলোর ব্যবহার। তার সঙ্গে অভিজিৎ চক্রবর্তীর আবহসঙ্গীত। আর পেছনের স্ক্রিনে ফুটে ওঠা কিছু পেন্টিং। ওথেলোর কণ্ঠে ভেসে আসে, “আমি তোমাকে ভালবাসব ডেসডিমোন, জীবনে ও মৃত্যুতেও!” তার পর সিঁড়ি বেয়ে উঠে যান ডেসডিমোনের কাছে। নিবিড় আলিঙ্গন করতে করতে নিজের হাউজকোট-টা খুলে ফেলেন। এর সঙ্গে ভেসে আসে ওথেলোর আর্তনাদ। সম্পূর্ণ বিবস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়ে ওঠেন স্টেজে। সারা শরীর কাঁপতে থাকে। দেখে কোনও ‘প্রোভোকেশন’ হয় না। বরং একটা যন্ত্রণার অনুভুতি তৈরি হয়। “নাটকটা নান্দনিক হল কি না সেটাই একমাত্র এবং শেষ কনসার্ন থাকে আমাদের কাছে। এই তো ‘ঊরুভঙ্গম’ বলে নাটকটা করেছি। বাংলা নাটকের টিকিট এত দিন ২০০ টাকায় বিক্রি হত। আমাদের ছ’ঘণ্টার নাটক লোকে ১০০০ টাকা দিয়ে কেটে দেখতে আসছে। তা-ও নাটকে কোনও স্টার নেই। এই ছ’ঘণ্টা ব্যপী কাজ করার সময় কিন্তু সেটা চলবে কি চলবে না তা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যাইনি আমরা। সে ভাবে এই নাটকটাও করছি,” বলছেন মণীশ।
আরও জানান যে দলগত ভাবে তাঁরা বেশ ট্র্যাডিশনাল থিয়েটার করে থাকেন। এই প্রথম শেক্সপিয়রের নাটক নিয়ে কাজ করলেন। “তাপস নিজেও বেশ নিরীহ প্রকৃতির ছেলে। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় বাড়ি। কলকাতাতে আমরা কমিউন করে থাকি। ওর বাড়ির কেউই এই নাটক এখনও দেখেননি। আমাদের সঙ্গে ওর অনেক দিনের সম্পর্ক। তাই নির্ভরশীলতা তৈরি হয়েছে। মহড়াতে ওর যন্ত্রণাটা দেখে, তারপর ওথেলোর যন্ত্রণাটা দেখে যে ভাবে আমরা রক্তবমি করেছি, আমাদের ধারণা ওর পরিবারেও একই অভিঘাত হবে নাটকটা দেখে। ওর নগ্নতা প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়াবে না। মানবিক যন্ত্রণার বোধ সংস্কারকে অতিক্রম করবে,” বলছেন পরিচালক।
প্রত্যেক মহড়ার পরে তাপসের অন্তত ১০ মিনিট লাগে স্বাভাবিক হতে। এক সময় পোলান্ডে গিয়ে কিছু নাটক করেছিলেন তিনি। সেখানে দেখেছিলেন, কী ভাবে অভিনেতারা তাঁদের শরীরকে একটা ‘ইকুইপমেন্ট’ হিসেবে ব্যবহার করেন। গ্রিনরুমের এক কোণে বসে ধীরে ধীরে বলেন, “এটা পুরোটাই একটা প্রসেস। শরীরটা আমার কাছে একটা যন্ত্র। এই দৃশ্যটা করার সময় সব থেকে যা বেশি দরকার তা হল মানসিক জোর। শরীরের সব শক্তিটাকে শুষে নিয়ে বোঝার চেষ্টা করতে হয় ওথেলোর ট্র্যাজেডির উৎসটা কোথায়?”
এক সময় ‘হ্যারি পটার’ অভিনেতা ড্যানিয়েল র্যাডক্লিফ মঞ্চে একটা নগ্নদৃশ্যে অভিনয় করে বেশ সাড়া ফেলেছিলেন। সে নাটকের নাম ছিল ‘ইকুয়াস।’ নাটকটা ছিল এক মনোবিদকে নিয়ে, যিনি চিকিৎসা করেন এমন এক যুবকের যার ঘোড়ার প্রতি অদ্ভুত আকর্ষণ। তাপস কি শুনেছেন ড্যানিয়েলের সেই নাটকের কথা? জানেন কী ভাবে তিনি মধু দিয়ে গায়ের লোম তুলেছিলেন এই নাটকে অভিনয় করার আগে? “নাটকটার কথা জানি। কিন্তু ওই মধু দিয়ে গায়ের লোম তোলার কথা শুনিনি,” বলেন অভিনেতা। নিজের প্রস্তুতি হিসেবে কি এমন কিছু করার প্রয়োজন অনুভব করেছেন কখনও? “না আমাদের এমন ওয়ার্কশপ হয়েছে যে এই সবের দরকার পড়েনি। এই গোটা ব্যাপারটা একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে না গেলে অভিনয় করাটা সম্ভব নয়। এটা এমন নয় যে চাইলেই হঠাৎ একটা দৃশ্যে নগ্ন হয়ে অভিনয় করা যায়!” বলছেন তাপস। |
|
‘দ্রৌপদী’র স্ক্রিপ্ট-এ নগ্নতা ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা
ছিল।
এই নাটকের ক্ষেত্রেও কি
সেটা রয়েছে?
সাবিত্রীদেবী |
|
আর নোয়া? যাঁকে বাংলার মঞ্চে প্রথম দেখা যায় ‘স্ত্রীর পত্র’ নাটকে। নোয়ার পক্ষেও এমন একটা দৃশ্যে অভিনয় করাটা যথেষ্ট কঠিন। অভিনয়ের শেষে আলো নিবিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দলের ছেলেরা ছুটে আসে তাপসের কাছে। গায়ের ওপর ফেলে দেয় চাদর। কোনও কোনও দিন নাকি তাপস এতই বিচলিত হয়ে পড়েন যে নোয়া নিজে এসে ওঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দেন। “তিন মাস আগে কালারিপায়াতু নাচের একটা ওয়ার্কশপ করতে এসেছিলাম। তার পর ‘স্ত্রীর পত্র’ করলাম। তখন মনীশদা এই নাটকের কথা বলেন,” জানালেন নোয়া।
ওই দৃশ্য অভিনয় করতে কুণ্ঠা বোধ হয় কি? “না। ভয়, গভীর প্রেম, দুঃখ সব মিলিয়ে মিশিয়ে সে এক অন্য ধরনের অনুভূতি,” জানাচ্ছেন নোয়া।
গত শনিবার কলকাতায় আবারও মঞ্চস্থ হয়েছিল ‘দ্রৌপদী।’ সেই নাটকের পরিচালক হেইসনাম কানাহাইলাল কি ভাবছেন এই প্রয়াস সম্পর্কে? তিনি বলছেন, “মনীশ আমাকে বলেছে তার নাটকটার কথা। আমি ‘ওথেলো’ পড়েছি। কিন্তু ওখানে নগ্নতার বিষয়টা নিয়ে কোনও আলোচনা এর আগে শুনিনি। আমরা যখন ‘দ্রৌপদী’তে নগ্নতা ব্যবহার করি তখন সেটা প্রতিবাদের একটা মাধ্যম। আমাদের জানা দরকার যে মনীশ কি কারণে এই নাটকে নগ্নতা ব্যবহার করেছেন।”
৬৯ বছর বয়সি সাবিত্রীদেবী শনিবার নান্দীকার নাট্যোৎসবে অভিনয় করে গিয়েছেন ‘দ্রৌপদী।’ মণিপুরে ফিরে গিয়ে কানহাইলালের কাছে এই নাটকটার কথা শুনেছেন। বলছেন, “আমি ‘ওথেলো’ পড়িনি। তবে নিজের নাটকের সম্পর্কে বলতে পারি, যে নগ্নতাকে আমি একটা প্রোটেস্টের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছি। আমার স্ক্রিপ্টটায় নগ্নতা ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা ছিল। এই নাটকের ক্ষেত্রেও কি সেই প্রয়োজনীয়তা রয়েছে?”
উত্তর অবশ্য মিলবে নতুন বছরেই। |
‘ওথেলো’র ক্ষেত্রে
আমরা নগ্নতা ব্যবহার
করেছি যন্ত্রণার কাব্য
রচনা করতে।
মণীষ মিত্র |
এই দৃশ্যে অভিনয় করে এক অদ্ভুত অনুভূতি হয়।
লজ্জা নয়।
ভয়, গভীর প্রেম, দুঃখ সব অনুভব করি।
নোয়া নার্নবার্গ |
আমি তিন মাস ভাত খাইনি। প্রত্যেকটা শো শেষ করে অন্তত দশ
মিনিট সময় লাগে স্বাভাবিক হতে। তারপর বরফগলা জলে স্নান করে নিই।
তাপস চট্টোপাধ্যায় |
|
|
|
|
|
|