|
|
|
|
বাড়ির মায়া ছেড়ে কলকাতা ‘মডেলে’ মজেছে মফস্সল
রাহুল রায় • কলকাতা |
চার-ছয় কাঠা জমির উপরে পায়রার খোপের মতো অগুন্তি ফ্ল্যাট-বাড়ির ভিড়। কলকাতার এই চেনা ছবিটা এখন ফ্রেম-বন্দি হয়ে উঠে এসেছে মফস্সলেও।
গত কয়েক বছরে রাজ্যের ‘টায়ার-২’ শহরগুলিও কলকাতার ফ্ল্যাট-সংস্কৃতির ছায়ায় ঢাকা পড়েছে। নিছক চোখের দেখা নয়, নগরোন্নয়ন দফতরের একটি রিপোর্ট বলছে, আসানসোল, দুর্গাপুর, শিলিগুড়ির সঙ্গে তাল মিলিয়ে আবাসনের ভিড়ে ক্রমেই মুখ ঢেকেছে বহরমপুর, বোলপুর-শান্তিনিকেতন, এমনকী, বাঁকুড়া, কাটোয়ার মতো ছোট শহরও।
রাজ্যের টায়ার-২ এবং টায়ার-৩ স্তরের এমনই বেশ কিছু শহরে গত কয়েক বছরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাড়ি তৈরির তুলনায় প্রোমোটারের তৎপরতায় ফ্ল্যাট বাড়ি গড়ার প্রবণতাও যে বেড়েছে, ওই রিপোর্টেই সে কথা তুলে ধরা হয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, ওই সব শহরে ব্যক্তিগত উদ্যোগে বাড়ি তৈরির তুলনায় আবাসন বা ফ্ল্যাট বাড়ি তৈরি ২৭ শতাংশ হারে বেড়েছে।
নগরোন্নয়ন দফতরের এক শীর্ষকর্তা বলেন, “বেসরকারি প্রোমোটার ছাড়া আবাসন দফতরও ওই সব শহরে ফ্ল্যাট তৈরি করছে। কোথাও আবার আবাসন দফতরের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ওই সব সাবেক মফস্সলে ফ্ল্যাট তৈরিতে এগিয়ে এসেছে নাম করা রিয়েল এস্টেট সংস্থাগুলি।” বড় শহরের অনুকরণে নিছকই নব্য-সংস্কৃতির প্রসার নয়, ওই সব মফস্সল কিংবা মহকুমা শহরে ফ্ল্যাটের যথেষ্ট চাহিদাও রয়েছে মফস্সলে। আবাসন নির্মাণের অন্তত বছর খানেক আগে তার অধিকাংশ বিক্রি হয়ে যাওয়া তারই প্রমাণ। |
|
আবাসন দফতরের এক কর্তার কথায়, “বছর কুড়ি আগে কলকাতার লাগোয়া জেলা শহরগুলিতে দেদার ফ্ল্যাট তৈরি করেছিল আবাসন দফতর। কিন্তু তার অধিকাংশই তখন বিক্রি হয়নি। কোন্নগর, চন্দননগর কিংবা বজবজ এলাকায় নদীর কোলে সুদৃশ্য এবং অপেক্ষাকৃত কম দামের সেই সব ফ্ল্যাট বিক্রি না হয়ে পড়েছিল দীর্ঘ দিন। সেই ছবিটাই এখন বদলে গিয়েছে।” কেন?
ওই দফতরের প্রাক্তন এক মুখ্য বাস্তুকারের ব্যাখ্যা, “আসলে সেই সময়ে কোনও সমীক্ষা না করেই ওই ফ্ল্যাটগুলি তৈরি করা হয়েছিল। শহরতলির মানুষ তখনও ফ্ল্যাট-সংস্কৃতিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেননি। গত কয়েক বছরে ছবিটা একেবারেই পাল্টে গিয়েছে। তাই বাঁকুড়া কিংবা কাটোয়ার মতো শহরেও এখন ফ্ল্যাট নির্মাণের বিজ্ঞাপন বেরোলেই হু হু করে তা বিকিয়ে যাচ্ছে।”
সল্টলেক ও নিউটাউনে বেশ কয়েকটি বহুতল আবাসন গড়েছে একটি সর্বভারতীয় রিয়েল এস্টেট সংস্থা। সংস্থার সিইও প্রমোদ অগ্রবাল বলেন, “বোলপুর কিংবা বর্ধমানের মতো পুরনো শহরেও এখন ফ্ল্যাট তৈরি করলে অবিক্রিত পড়ে থাকছে না। তাই আমরাও ওই সব এলাকায় আবাসন তৈরির কথা ভাবছি।”
আসানসোল, দুর্গাপুর কিংবা শিলিগুড়ির ব্যবসায়িক গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে ওই সব টায়ার-২ শহরে বছর কয়েক ধরে আবাসন তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে পরিচিত রিয়েল এস্টেট সংস্থাগুলি। কলকাতা কিংবা শহরতলি ছেড়ে পুরনো মফস্সলেও আবাসনের বাজার তৈরি হয়েছে বলেই যে সংস্থাগুলি এগিয়ে এসেছে তা বলা বাহুল্য। ওই সব সংস্থার বিপণন শাখার কর্তাদের এ ব্যাপারে একটা ব্যাখ্যা রয়েছে। তাঁরা জানান, আসানসোল-দুর্গাপুরের মতো শিল্পাঞ্চল কিংবা বিভিন্ন ব্যবসার নিরিখে গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় ওই সব শহরে অবস্থাপন্নের ভিড় বেড়েছে যথেষ্ট। আবাসনগুলিতে সুইমিংপুল, জিম, সুদৃশ্য ডিপার্টমেন্টাল স্টোর এমনকী স্কুল, হাসপাতালের বিবিধ সুবিধা ও স্বাচ্ছন্দ্যের যথেষ্ট উপকরণ মজুত থাকায় অবস্থাপন্নদের সে দিকে নজর পড়েছে বলেই মনে করছেন তাঁরা। তাই ওই সব শহরে আবাসনের কদর বাড়ছে। রাজ্যের ছোট শহরগুলিতে বিভিন্ন আকারের আবাসন গড়তে তাই ইতিমধ্যেই প্রায় চার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে ওই সংস্থাগুলি।
কিন্তু বর্ধমান, বোলপুর কিংবা কাটোয়ার মতো শহরে আবাসনের কদর বাড়ার কারণ কী?
বিশিষ্ট লাইফ-স্টাইল বিশেষজ্ঞ অনিতা সান্যাল বলছেন, “বিশ্বায়নের বাজারে পণ্য সংস্কৃতির ঢেউ লেগেছে মফস্সলেও। সাধারণ মধ্যবিত্তের জীবনযাপনের ধরনটাই বদলে গিয়েছে। তাই মধ্যবিত্তের কাছে নিজের বাড়ির চেয়ে ফ্ল্যাটই এখন বেশি পছন্দের। নিরাপত্তার প্রশ্নটিও ভেবে দেখছেন অনেকে। আবাসনগুলির নিরাপত্তা সাধারণ বাড়ির তুলনায় বেশি হওয়ার কারণেও অনেকে সে দিকে ঝুঁকছেন।” গৃহসজ্জা সংক্রান্ত একটি সর্বভারতীয় পত্রিকার সহ-সম্পাদক আনন্দ শর্মার ব্যাখ্যাটা আবার একটু অন্য রকম, “মফস্সল সব সময়েই বড় শহররের হাল ফ্যাশনের জীবনযাপনে আকৃষ্ট হয়। খেয়াল করলে দেখবেন, পশ্চিমবঙ্গের ছোট শহরের বাসিন্দারা কলকাতা বা অন্য বড় শহরের অনুকরণ করেই নিজেদের জীবনযাপন সাজাতে চাইছেন। রামপুরহাট বা বর্ধমানে সে কারণেই গড়ে উঠছে ফ্ল্যাট-সংস্কৃতি।” বাগানে পুঁইমাচা, উঠোনে তুলসীতলার মায়া কাটিয়ে হালের সেই সংস্কৃতির হাত ধরে মফস্সল তাই উঠে যাচ্ছে আবাসনের নিশ্চিন্ত ঘেরাটোপে। |
|
|
|
|
|