|
|
|
|
|
কৃত্রিম অঙ্গেও আতঙ্ক,
সতর্কবার্তা কেন্দ্রের
সুরবেক বিশ্বাস • কলকাতা |
|
এক ঝলক দেখলে মনে হতে পারে, মহিলা গর্ভবতী। কিন্তু কৃত্রিম ভাবে ফোলানো পেটে আসলে লুকনো রয়েছে মাদক। এমনকী থাকতে পারে বিস্ফোরকও।
চলতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসে কলম্বিয়ার বোগোটা বিমানবন্দরে এমনই এক ‘ভুয়ো গর্ভবতী’কে ধরে ফেলেছিল পুলিশ। দেখা যায়, কৃত্রিম পেটের ভিতরে দু’কেজি কোকেন নিয়ে টরন্টোয় যাচ্ছিলেন টাবিথা লি রিচি নামে বছর আঠাশের ওই তরুণী। সেই ঘটনার কথা উল্লেখ করেই পশ্চিমবঙ্গ-সহ সব রাজ্যকে সম্প্রতি এক সতর্কবার্তা দিয়েছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। তাতে বলা হয়েছে, এই ভাবে কৃত্রিম গর্ভের মধ্যে ‘ইম্প্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস’ (আইইডি) লুকিয়ে নাশকতা ঘটানোরও চেষ্টা করতে পারে জঙ্গিরা। তাই প্রত্যেকটি বিমানবন্দর এবং ভিআইপি-দের নিরাপত্তা নিয়ে রাজ্যগুলিকে আরও সতর্ক হতে বলেছে কেন্দ্র।
কৃত্রিম গর্ভে মাদক পাচার বা বিস্ফোরক লুকিয়ে রাখা নতুন ঘটনা নয়। সেই আটের দশকে অমিতাভ বচ্চনের ‘খুদ্দার’ ছবিতে পরভিন বাবিকে এই ভাবেই চোলাইয়ের বোতল লুকিয়ে রাখতে দেখা গিয়েছিল। বাস্তবেও একই পদ্ধতিতে ২০০৬-এর ২৫ এপ্রিল শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোয় বিস্ফোরণ ঘটায় এলটিটিই-র এক আত্মঘাতী মহিলা জঙ্গি। কৃত্রিম গর্ভে আইইডি নিয়ে কলম্বোয় শ্রীলঙ্কা সেনার সদর দফতরে ঢুকে পড়েছিল সে। সেই বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছিলেন আট জন। জখম ২৭। গুরুতর জখম হন সেনা কম্যান্ডার লেফটেন্যান্ট জেনারেল সরথ ফনসেকাও।
তবে এই রকম কৃত্রিম পেট ছাড়াও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের সাম্প্রতিক সতর্কবার্তায় মানবদেহের কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গে লুকনো বিস্ফোরকের বিপদের কথাও বলা হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে কৃত্রিম হাত বা পা নেহাতই নিরীহ বস্তু। কিন্তু তার মধ্যেও জঙ্গিরা আইইডি নিয়ে যেতে পারে বলে রাজ্যগুলিকে সতর্ক করেছে কেন্দ্র।
কিন্তু এটাও কি সম্ভব? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বক্তব্য অবশ্য সে রকমই ইঙ্গিত করছে। মন্ত্রকের ব্যাখ্যা, প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য তৈরি কৃত্রিম হাত বা পায়ের কিছুটা অংশ ধাতু দিয়ে বানানো হয়। তার ভিতরের ফাঁপা অংশে আইইডি কিংবা ছোট আকারের আগ্নেয়াস্ত্র লুকিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সহজেই। কৃত্রিম অঙ্গের কিছুটা এমনিতেই ধাতু দিয়ে তৈরি বলে ‘মেটাল ডিটেক্টরে’ তার মধ্যে লুকনো আইইডি আলাদা করে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। আবার অনেক সময়, ভাঙা হাত বা পায়ের হাড় জোড়ার জন্য করা প্লাস্টারের ছাঁচের মধ্যেই প্লাস্টিক বিস্ফোরক লুকিয়ে নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। গোয়েন্দারা জেনেছেন, সে ক্ষেত্রে ফিনফিনে চাদরের আকারের প্লাস্টিক বিস্ফোরককে মুড়ে রাখে ওই প্লাস্টারের ছাঁচ। ঠিক এ ভাবেই ‘ডেথ রেস ২০০০’ নামে হলিউডের এক ছবিতে দেশের প্রেসিডেন্টকে হত্যার ছক কষেছিল ফ্রাঙ্কেনস্টাইন নামে ছবির এক চরিত্র। ছবিতে তার কৃত্রিম ডান হাতে লুকনো ছিল গ্রেনেড। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন পরিকল্পনা করে, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে করমর্দনের সময়ে ওই ‘হ্যান্ড গ্রেনেড’-এর বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাঁকে হত্যা করবে। ব্যাটম্যান সিরিজের ছবি ‘দ্য ডার্ক নাইট’-এও রয়েছে শরীরের মধ্যে লুকনো বিস্ফোরকের ব্যবহার। ছবির খলনায়ক জোকার বোমা ফাটিয়ে উড়িয়ে দিয়েছিল আস্ত একটি থানা। আর সেই বোমা লুকনো ছিল তার পাকস্থলীতে!
তবে এতেই শেষ নয়। কৃত্রিম গর্ভ, হাত-পা এবং প্লাস্টারের ছাঁচ ছাড়াও বিস্ফোরক লুকনোর জন্য শরীরের নতুন অংশের সন্ধান দিয়েছিল আল কায়দা জঙ্গিগোষ্ঠী। তথ্য বলছে, পায়ুর মধ্যে আইইডি লুকিয়ে রেখে ২০০৯-এর অগস্টে সৌদি আরবের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রীকে হত্যার চেষ্টা করেছিল সে দেশের আল কায়দা জঙ্গি আবদুল্লা আল আসিরি। জঙ্গি ইতিহাসে বিস্ফোরণের কাজে পায়ুর ব্যবহার সম্ভবত এই প্রথম।
কিন্তু এ তো গেল বিদেশের কথা। বাস্তবে কৃত্রিম পেটের মধ্যে বিস্ফোরক লুকিয়ে আনা কিংবা কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গে আইইডি লুকনোর বিপদ পশ্চিমবঙ্গে ঠিক কতটা? রাজ্য গোয়েন্দা পুলিশের এক শীর্ষকর্তা বলেন, “লস্কর-ই-তইবা কিংবা ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন (আইএম)-এর মতো জঙ্গি সংগঠন এখনও এই রাজ্যে বিস্ফোরণ ঘটায়নি। এখানে যা বিস্ফোরণ, সেই সব মূলত মাওবাদীদের ঘটানো। তারা মূলত কোনও জায়গায় আইইডি রেখে বিস্ফোরণ ঘটায়। কিন্তু ভবিষ্যতে আইএম কিংবা মাওবাদীরা কৃত্রিম অঙ্গে লুকনো বিস্ফোরক দিয়ে নাশকতা যে ঘটাবে না, এমন কথা জোর দিয়ে কে বলতে পারে! মাথায় রাখতে হবে, মাওবাদীদের একটা অংশ এলটিটিই-র কাছ থেকে জঙ্গি হানার প্রশিক্ষণ নিয়েছে।” ওই অফিসারের আরও বক্তব্য, “লস্করের একাংশের সঙ্গেও কিন্তু তামিল টাইগারদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল।”
সে ক্ষেত্রে মানবদেহের কৃত্রিম অঙ্গে লুকনো আইইডি কিংবা বিস্ফোরক শনাক্ত করার উপায় কী? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের ওই সতর্কবার্তা তো বটেই, ইউরোপীয় পুলিশ এজেন্সি (ইউরোপোল)-র ‘কাউন্টার টেররিজম বুলেটিন’-এ মেনে নেওয়া হয়েছে, মেটাল ডিটেক্টর কোন ছার, কলকাতা-সহ বেশ কয়েকটি বিমানবন্দরে বসানো ‘এক্সপ্লোসিভ ডিটেক্টর’ নামে যন্ত্রও কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যে লুকনো আইইডি কিংবা বিস্ফোরক শনাক্ত করতে তেমন সফল নয়। ‘স্নিফার ডগের’ পক্ষেও কৃত্রিম অঙ্গে লুকনো আইইডি-র সন্ধান পাওয়া কঠিন বলে জানাচ্ছেন আইবি-র বিশেষজ্ঞরা।
তা হলে উপায় কী? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের বক্তব্য, এক্স-রে প্রযুক্তিনির্ভর উন্নত মানের ‘বডি স্ক্যানার’ এবং সেই সব যন্ত্রপাতি চালানোর জন্য যথাযথ প্রশিক্ষিত ও সদা সচেতন নিরাপত্তারক্ষীদের দিয়ে এই সমস্যার কিছুটা সমাধান হতে পারে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক এই ব্যাপারে ‘কাস্ট স্কোপ’ এবং ‘ডিজিটাল রেডিওগ্রাফিক স্ক্যানার’ (ডিআরএস)এই দু’টি যন্ত্রের কথা উল্লেখ করেছে। শারীরিক প্রতিবন্ধীদের তল্লাশি চালানোর বিষয়টি এমনিতেই স্পর্শকাতর। তবে এই যন্ত্রগুলি প্রতিবন্ধীদের শরীর থেকে কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ না খুলেই সেগুলির অন্তর্ভেদী ছবি নিতে পারে। গোয়েন্দারা জানাচ্ছেন, হুইল চেয়ারে বসা অবস্থাতেও কোনও মানুষের উপর পুরোদস্তুর তল্লাশি চালাতে পারে ডিআরএস।
যদিও রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তার বক্তব্য, “এই সব আধুনিক যন্ত্র দেশের খুব কম জায়গায় রয়েছে। এই রাজ্যে এখনও আসেনি। এই অবস্থায় তল্লাশিতে ভরসা প্রশিক্ষিত ও দক্ষ নিরাপত্তারক্ষীরাই।”
|
বিস্ফোরক থাকতে পারে |
• মহিলার কৃত্রিম গর্ভে
• ভাঙা হাত-পায়ের প্লাস্টারে
•
পায়ুর মধ্যে লুকিয়ে
•
কৃত্রিম হাত-পায়ের ফাঁপা অংশে |
|
|
|
|
|
|