|
|
|
|
৯০ ভাগ টাকা এখনই ব্যয়ের ছাড়পত্র পেল সব দফতর
দেবজিৎ ভট্টাচার্য • কলকাতা |
কথা কম, কাজ বেশির নির্দেশই শুধু নয় অর্থাভাবে প্রকল্পের কাজ যাতে আটকে না থাকে, সেই বন্দোবস্তও করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আর্থিক বছর শেষ হওয়ার সাড়ে তিন মাস আগে ডিসেম্বরেই অর্থ দফতর জানিয়ে দিল, রাজ্যের পরিকল্পনা বাজেটের ৯০% অর্থ নিজেরাই খরচ করতে পারবে সমস্ত দফতর। বাকি ১০% খরচের জন্য অর্থ দফতরের অনুমতি লাগবে।
সরকারি সূত্রের খবর, এক আর্থিক বছরে পরিকল্পনা বাজেটের টাকা সমান চার কিস্তিতে দেওয়ার নিয়ম চালু রয়েছে রাজ্যে। সেই মতো ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭৫% অর্থ খরচের অনুমতি দেওয়া হতো দফতরগুলিকে। এ বার মূলত রাজস্ব আদায় ভাল হওয়ায় ব্যতিক্রমী পথে হেঁটে চলতি মাসেই ৯০% পর্যন্ত খরচের অনুমতি দিয়েছে রাজ্য সরকার। অর্থ দফতরের এক কর্তা জানান, অতীতে এমন অনেক বছর দেখা গিয়েছে, যখন সব মিলিয়ে ৭৫%-এর বেশি অর্থ খরচের অনুমতিই দেওয়া হতো না। কারণ হিসেবে বলা হতো, দফতরগুলি প্রাপ্য মঞ্জুরির টাকা খরচ করতে পারেনি বলেই চতুর্থ তথা শেষ কিস্তির ২৫% অর্থ অনুমোদন দেওয়া হয়নি। যদিও বিভিন্ন দফতরের অভিযোগ ছিল, আসলে কোষাগারে টাকা না থাকার কারণেই উন্নয়নের শেষ কিস্তির টাকা দিতে পারতো না সরকার। এ বার আর্থিক বছর শেষ হওয়ার তিন মাস আগেই এক ধাক্কায় ৯০% খরচের অনুমতি দিয়ে কার্যত নজির তৈরি করল সরকার।
এবং এই নতুন ব্যবস্থায় উন্নয়নের গতি বাড়বে বলেই মনে করছেন বিভিন্ন দফতরের আধিকারিকেরা। নবান্নের এক কর্তা বলেন, “প্রকল্পের বিস্তারিত রিপোর্ট (ডিপিআর) জমা দেওয়া পরেও অর্থ দফতর টাকা মঞ্জুর করছে না এই অভিযোগ বহু দিনের। কিছু ক্ষেত্রে তার সত্যতা মিললেও অনেক সময় পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে খরচের ছাড়পত্র আটকে রাখত অর্থ দফতর। সেই ত্রুটি সংশোধনের জন্য ফাইল ফিরিয়ে দেওয়া হতো সংশ্লিষ্ট দফতরে। এবং মূলত এই কারণে প্রকল্পের গতি অনেকাংশে থমকে যেতো।” এখন টাকা খরচের পদ্ধতিটাই আমূল বদলে গিয়েছে। আধিকারিকদের বক্তব্য, “এখন নিজেরাই প্রকল্প তৈরি করছি, নিজেরাই অনুমোদন দিচ্ছি। তাই তিন মাস আগেই বাজেট বরাদ্দের প্রায় পুরো টাকা (মাত্র ১০% বাদ) খরচের ছাড়পত্র মেলায় উন্নয়নের কাজে আরও গতি আসবে বলেই মনে হয়।”
সচিবদের একাংশ এমন দাবি করলেও প্রকল্পপিছু অর্থ খরচের নিরিখে যে এখনও তাঁদের অনেকের কাজে তিনি সন্তুষ্ট নন, শুক্রবার টাউন হলের পর্যালোচনা বৈঠকে তা বুঝিয়ে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। অর্থ দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, চলতি আর্থিক বছরে পরিকল্পনা বাজেটে যেখানে ২৬ হাজার ৬৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ের কথা ঘোষণা করেছেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র, সেখানে দফতরগুলি সব মিলিয়ে এখনও ১৫ হাজার কোটির বেশি খরচ করতে পারেনি। অর্থাৎ, বছরের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ সময় কেটে গেলেও খরচ হয়েছে মোট বরাদ্দের ৫৬ ভাগ টাকা। আগামী তিন মাসে বাকি ৪৪% খরচ করা সম্ভব কি না, সেই প্রশ্ন তুলেছেন অর্থ দফতরেরই একাংশ।
এই বাস্তব অবস্থা জেনেও দফতরগুলিকে এখনই ৯০% খরচের অনুমতি দেওয়ার প্রধান কারণ যে ভাল রাজস্ব আদায়, এটা মানছেন রাজ্য প্রশাসনের একাধিক কর্তা। শুক্রবার পর্যালোচনা বৈঠকের পরেও মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, “চরম আর্থিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে। বাম জমানার ঋণ আর সুদ মেটাতেই বহু টাকা চলে যাচ্ছে। তার পরেও রাজস্ব আদায় ৩২% বেড়েছে।” রাজস্ব আদায়ের এই অগ্রগতিই বহু দিনের প্রথা ভাঙতে সরকারকে সাহস জুগিয়েছে বলে মনে করছেন প্রশাসনের একাংশ। তাঁদের বক্তব্য, এতে এক দিকে যেমন আমজনতার কাছে রাজস্ব বৃদ্ধির বার্তা দিল সরকার, তেমনই কাজে গতি আনার ক্ষেত্রে দফতরের সচিব ও অফিসারদের উপরে আরও চাপ তৈরি করা হল। তাঁদের বুঝিয়ে দেওয়া গেল, অর্থাভাবে প্রকল্প শেষ করা গেল না এমন কথা সরকার বরদাস্ত করবে না।
বরদাস্ত না করার ইঙ্গিতও রয়েছে বিজ্ঞপ্তিতে। তাতে বলা হয়েছে, কবে কোন প্রকল্পে কত টাকা ছাড়া হল তার বিস্তারিত তথ্য দ্রুত জানাতে হবে দফতরগুলিকে। যদি কোনও ফাইল অর্থ দফতরে পড়ে থাকে, তা হলে সেটি কোন প্রকল্প সংক্রান্ত এবং ওই প্রকল্পের সম্ভাব্য খরচ কত ধরা হয়েছে, জানাতে হবে তা-ও। কেন এই নির্দেশ? অর্থ দফতরের এক কর্তা বলেন, “বিভিন্ন সময়ে কিছু দফতর আমাদের বিরুদ্ধে দেরিতে টাকা ছাড়া বা না ছাড়ার অভিযোগ আনলেও দেখা গিয়েছে, আমরা তার বিন্দুবিসর্গ জানি না! পরে নথি মিলিয়ে জানা যায়, ওই কাজের কিছু ইউসি (কাজ শেষের সংশাপত্র) অর্থ দফতরে আসেনি। ফলে নিয়ম মেনে টাকা ছাড়া যায়নি।” সব দফতরের সঙ্গে অর্থ দফতরের সমন্বয় তৈরি করতেই প্রকল্প সংক্রান্ত খুঁটিনাটি জানতে চাওয়া হয়েছে।
টাকা ছাড়ার ক্ষেত্রে কী ভাবে দফতরগুলিকে স্বাধীনতা দিল বর্তমান সরকার? কী ভাবে আগের আমলের লাল ফিতের ফাঁস আলগা হল? রাজ্য প্রশাসনের এক কর্তা জানাচ্ছেন, প্রকল্প অনুমোদনে বাকি দফতরগুলিকে যাতে অর্থ দফতরের মুখাপেক্ষী হয়ে না থাকতে হয়, তার জন্য শিল্প, পূর্ত, শ্রম ও স্বরাষ্ট্রের মতো দফতরগুলিতে আর্থিক উপদেষ্টা (ফিনান্সিয়াল অ্যাডভাইসার) নিয়োগ করে সরকার। গোড়ায় তাঁদের প্রকল্পপিছু ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত খরচের অধিকার দেওয়া হলেও পরে তা ২০ কোটি করা হয়। এখন বহু দফতর আর্থিক উপদেষ্টা নিয়োগ করায় তাদের ছোট ও মাঝারি প্রকল্পের ফাইল যায় না অর্থ দফতরে।
যদিও কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলিতে টাকা (ম্যাচিং গ্রান্ট, অর্থাৎ রাজ্যের অংশ) ছাড়ার অধিকার নিজের হাতে রেখেছে অর্থ দফতর। এক কর্তা জানান, কর্মী সহায়তা প্রকল্প, গ্রামীণ পরিকাঠামো বা সীমান্ত উন্নয়ন, রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনা-র মতো কেন্দ্রীয় প্রকল্পগুলিতে রাজ্যের বরাদ্দ নির্দিষ্ট থাকে। কেন্দ্র টাকা পাঠালেও রাজ্যের বরাদ্দ অনুমোদন করার মতো পরিস্থিতি থাকে না। বিষয়টি কেন্দ্রীয় ভাবে অর্থ দফতরের হাতে রাখা হয়েছে। |
|
|
|
|
|