নতুন নাতনি
কাল ভুলু চোরের মেয়ের জন্মদিন। পাঁচ বছরের জন্মদিনে ভাল একটা খেলনা সে উপহার দেবে বলে ঠিক করেছে। ভুলুর বউ চুমকি বিকেল থেকে ভুলুকে তাড়া দিচ্ছে, ‘যাও মেয়েটার জন্য এ বার বেরোও, আজকে দামি কিছু একটা খেলনা চুরি করে আনতে হবে কিন্তু। আমি পায়েসের সব জিনিস রেডি করছি।’ ভুলু শুয়ে ছিল। আড়মোড়া ভেঙে বলল, ‘দাঁড়াও না, সবে তো বিকেল। এখন চুরি করতে গেলে তো হাতেনাতে ধরা পড়ব। রাতেই বেরোব। বাচ্চা আছে এমন বাড়ি দেখে ঢুকতে হবে।’
শীতের রাত। অনেকক্ষণ এ দিক ও দিক ঘুরে দেখল ভুলু। মনে মনে বলল, ‘কী করে বুঝি এখন, কার বাড়িতে বাচ্চা আছে? দেরি না করে কোনও বাড়িতে ঢুকে পড়াই ভাল।’ কাছেই একটা ফ্ল্যাট বাড়ির তিন তলায় পাইপ বেয়ে উঠে পড়ল ভুলু। রান্নাঘরের কাচের জানলা হাট করে খোলা। শাবলের চাড় দিতেই খুলে গেল গ্রিল। তন্নতন্ন করে খুঁজল মেয়ের জন্য পছন্দসই খেলনা। খেলনা না পেয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও আলমারি খুলে বসল ভুলু। সে বিলক্ষণ জানে, আলমারিতে খেলনা পাওয়া যাবে না। আলমারি খুলেই তার চক্ষু চড়কগাছ। লকারে চকচক করছে সোনার গয়না, থরে থরে সাজানো প্রচুর টাকা।
কিন্তু ভুলু চোর উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে চুরি করে না। প্রত্যেক দিনই চুরির এক একটা বিশেষ লক্ষ্য থাকে। কোনও দিন চুমকির জন্যে শাড়ি-গয়না, কোনও দিন বাসন, আবার কোনও দিন দামি মোবাইল ফোন...। এ দিন টুম্পার জন্য এসেছে খেলনা চুরি করতে। ভুলু কিছুই না পেয়ে বেডরুমে ঢুকে পড়ল। দু’জন বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ঘুমোচ্ছেন। ফ্ল্যাটে আর কেউ নেই।
খেলনা না পেয়ে ভুলু পড়ল মহাবিপাকে। মেঝের ওপর বসে ভাবতে লাগল, সূর্য ওঠার সময় হয়ে আসছে। এখন আর অন্য কোনও বাড়িতে চুরি করতে যাওয়া সম্ভব নয়। অথচ কালই মেয়েটার জন্মদিন। কী করা যায়, ভেবে না পেয়ে রেগে গিয়ে ভুলু বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে ঘুম থেকে তুলল। চোখ কচলাতে কচলাতে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা উঠে শান দেওয়া ছুরি দেখে তাঁদের চোখ থেকে গভীর ঘুম উধাও। বৃদ্ধ বললেন, ‘কে তুমি? কী চাও? এত রাতে এখানে এলে কী করে?’ বৃদ্ধা বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘মাঝ রাতে ঘুম থেকে তুলে এ কী অসভ্যতামি?’ বৃদ্ধার প্রতিবাদে খানিকটা ঘাবড়ে গেল ভুলু। নিজেকে খানিকটা সামলে বলল, ‘একদম চিৎকার করার চেষ্টা করবেন না, দেখছেন হাতে কী? এক বার গলায় চুমু খেলেই সব খেলা শেষ।’ বৃদ্ধ অবস্থা সামাল দিতে বললেন, ‘ঠিক আছে, চিৎকার করছি না। ওটা সামনে থেকে সরাও। ভয় করছে।’ চোর ছুরিটা সরিয়ে বলল, ‘শুনুন, আমি চোর। আপনাদের ফ্ল্যাটে ঢুকেছিলাম চুরি করতে। কিন্তু কী রকম ফ্ল্যাট আপনাদের, একটাও খেলনা নেই?’ বৃদ্ধা চমকে উঠে বললেন, ‘খেলনা দিয়ে কী হবে?’ চোর বলল, ‘চুরি করব।’ চোরের কথা শুনে হো হো করে হাসতে হাসতে বৃদ্ধার চোখে পড়ল আলমারিটা হাট করে খোলা। চিৎকার করে উঠলেন। ভুলু চোর বলল, ‘উত্তেজিত হবেন না।
আলমারিটা আমিই খুলেছি। লকারে সোনার গয়না আর টাকাপয়সা ছাড়া আর তো কিছুই নেই।’ বৃদ্ধ হতচকিত হয়ে বললেন, ‘আর তোমার কী চাই বাবা?’ চোর বলল, ‘আমার মেয়ের কাল জন্মদিন। আজ ওর জন্য খেলনা চুরি করতে বেরিয়েছি। অন্য কিছু আজ চুরি করতে পারব না। কোথাও একটা খেলনা পেলাম না যে কাল টুম্পার হাতে দেব। শীতের রাতে পাইপ বেয়ে তিন তলায় ওঠা চাট্টিখানি কথা নয়। তার পরও যদি ঠিক জিনিসটা চুরি করতে না পারি, কেমন লাগে বলুন?’ ভুলু চোরের এই সরল জবানবন্দিতে বৃদ্ধ খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে বললেন, ‘হ্যাঁ, তোমার মনের অবস্থা আমি অনুমান করতে পারছি। কিন্তু বিশ্বাস করো, এমন আদর্শবান চোরের কথা আগে কোনও দিন শুনিনি। তোমাকে আমাদের বেশ ভাল লেগেছে। আসলে এই বাড়িতে ছোট বাচ্চা তো কেউ নেই, তাই খেলনাও নেই। খেলনার বদলে তোমার যা মন চায়, তুমি নির্দ্বিধায় নিতে পারো।’ চোর বলল, ‘অন্য জিনিস তো আমার দরকার নেই। কী রকম লোক মশাই? দম দেওয়া ট্রেন বা গাড়ি না থাকুক, কম দামের পুতুল বা রং পেনসিল তো রাখতে হয়? মেলায় যাওয়াও কি ভুলে গেছেন?’
ভুলুর কথায় হেসে বৃদ্ধ বললেন, ‘এই বয়সে আর মেলায় গিয়ে কী করব? কার জন্যই বা খেলনা কিনব বলো?’ বৃদ্ধা বললেন, ‘তা হলে চুরি করতে এসে তোমার সত্যিই কোনও লাভ হল না দেখছি।’ ভুলু অসহায় মুখে বলল, ‘সূর্য প্রায় উঠি উঠি, এখন কী করি বলুন তো? মেয়েকে কী উপহার দেব? তা ছাড়া খালি হাতে বাড়ি ফিরলে টুম্পার মা তো আমার পিঠের ছাল তুলে দেবে।’ চোরের কথা শুনে ভারী কষ্ট হল বৃদ্ধার। তিনি বৃদ্ধকে বললেন, ‘হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছ কেন? ওর মেয়ের জন্য কিছু তো একটা করো।’ বৃদ্ধ বললেন, ‘এক কাজ করো, তোমার বাড়ির ঠিকানাটা দিয়ে যাও। কাল তোমার বাড়ি গিয়ে জন্মদিনের গিফ্ট আমি পৌঁছে দিয়ে আসব।’ চোর তৎক্ষণাৎ জবাব দিল, ‘মাথাখারাপ নাকি? আমি বাড়ির ঠিকানা আপনাকে দিই আর আপনি পুলিশ নিয়ে আমার বাড়িতে গিয়ে টুম্পার জন্মদিনের দিন আমায় ধরিয়ে দিন। ও সব চক্করে আমি নেই।’ বৃদ্ধা বললেন, ‘ঠিক আছে, ঠিকানা তোমার দিতে হবে না, শুধু মোবাইল নম্বরটা দিয়ে যাও। গিফ্ট কিনে ফোন করলে তুমি এখানে এসে সেটা নিয়ে যেয়ো, কেমন?’ চোর বলল, ‘অত বোকা আমি নই। মোবাইল নম্বর দিয়ে বিপদ ডেকে আনবার পাত্র আমি নই।’
বৃদ্ধা বললেন, ‘তা হলে এখন কী উপায় হবে? তুমি ঠিকানাও দেবে না। মোবাইল নম্বরও দেবে না। গিফ্টটা তা হলে দেব কী ভাবে?’ বৃদ্ধ বললেন, ‘অথচ আবার বলছ খেলনা বাড়িতে না নিয়ে গেলে তোমার চলবে না। মেয়েকে জন্মদিনে তা হলে কেমন করে উপহারটা দেবে শুনি?’ চোরও ভীষণ চিন্তায় পড়ে গেল। বৃদ্ধ বললেন, ‘উপায় একটা আছে।’ চোর আর বৃদ্ধা অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল বৃদ্ধের মুখে। বৃদ্ধ চোরকে বললেন, ‘তোমার ঠিকানা, মোবাইল নম্বর কিছুই দিতে হবে না। তুমি তোমার মেয়ে আর বউকে নিয়ে কাল সন্ধেবেলা এখানে চলে এসো। তা হলেই সব সমস্যার সমাধান।’ অবিশ্বাসী চোখে ভুলু চোর বলল, ‘দেখবেন কোনও রকম ঝামেলা করবেন না। ফল কিন্তু ভাল হবে না।’ বৃদ্ধা বললেন, ‘আমাদের ওপর ভরসা রাখো। কোনও চিন্তা নেই। তোমার মেয়ের জন্মদিনের গিফ্ট আমরা সকাল সকাল কিনে রাখব।’ ইতঃস্তত করে চোর বলল, ‘আপনারা এত করে বলছেন বলে আমি রাজি হলাম। কথার দাম যেন থাকে।’ চোর রাজি হওয়ায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধার চোখেমুখে ফুটে উঠল প্রশান্তির হাসি।
পরদিন সন্ধেবেলা যথাসময়ে ভুলু বউ আর মেয়ে টুম্পাকে নিয়ে ফ্ল্যাটে হাজির হতেই তার চক্ষু ছানাবড়া। রঙিন বেলুনে সেজেছে গোটা ফ্ল্যাট। টুম্পাকে হাত ধরে ভিতরে নিয়ে গেলেন বৃদ্ধা। চুমকিকেও ডেকে নিলেন। নতুন রঙিন জরির জামা পরিয়ে নিজের হাতে ভাল করে সাজিয়ে দিলেন। আনন্দে খিলখিল করে হাসছে টুম্পা। তার পর হল কেক কাটা। বৃদ্ধ টুম্পাকে আদর করে নিয়ে গেলেন অন্য ঘরে। সেই ঘরে থরে থরে খেলনা সাজানো। টেডি বিয়ার, দম দেওয়া ট্রেন, বেশ কয়েকটি পুতুল, রং পেনসিল, এরোপ্লেন, গাড়ি সহ নানান ধরনের ক্যাডবেরি। ক্যাডবেরি আর অত রকম খেলনা পেয়ে মহাখুশি টুম্পা। রাত বেশি হয়ে যাচ্ছে দেখে বৃদ্ধ চোরকে বললেন, ভুলু এ বার খেতে বসতে হবে যে।
মহাভোজের আয়োজন। ভুলু নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারছে না। মনে মনে সে বৃদ্ধ-বৃদ্ধার কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে, তার অবিশ্বাসী মন, খারাপ ব্যবহারের জন্য। একসঙ্গে খাবার টেবিলে বসে খেতে খেতে বৃদ্ধ বললেন, ‘আমাদের একমাত্র ছেলে সস্ত্রীক আমেরিকায় থাকে তাদেরও ঠিক টুম্পার মতো একটা মেয়ে আছে। আমরা তার অনেক ছবি দেখেছি। স্কাইপে তার সঙ্গে গল্পও করেছি। কিন্তু নাতনিকে এক বার চোখে দেখার সৌভাগ্য এখনও আমাদের হয়নি।’

ছবি: সুমিত্র বসাক।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.