খুড়তুতো ভাইকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পাচ্ছিলেন না করণদিঘির সৈয়দপুরের বাসিন্দা শুভজিৎ বিশ্বাস। শুক্রবার সকালেই তাঁর ভাই কালুয়া স্ত্রী অধিকা ও সাত মাসের ছেলে মুন্নাকে মোটরবাইকে করে সৈয়দপুর থেকে রায়গঞ্জ যাচ্ছিলেন।
রায়গঞ্জের পাওয়ারহাউস এলাকার খানাখন্দে ভরা ৩৪ নম্বর জাতীয় সড়ক দিয়ে বাইক চালাতে গিয়ে কালুয়াবাবু নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। বাইকটি রাস্তার পাশের প্রায় দুই ফুট গর্তে নেমে যায়। সেখান থেকে বাইকটি রাস্তায় ওঠানোর সময়ে ঝাঁকুনিতে বাইক থেকে তাঁর স্ত্রী ও সন্তান জাতীয় সড়কের উপর ছিটকে পড়েন। সেইসময় শিলিগুড়িগামী একটি বড় ট্রেলার অধিকাদেবী ও তাঁর ছেলে মুন্নাকে পিষে দিলে ঘটনাস্থলেই তাঁদের মৃত্যু হয়। |
শুভজিৎবাবু বলছিলেন, “বেহাল রাস্তার জন্য যানজটে বাস বা ট্রেকারে চেপে রায়গঞ্জ যেতে অনেক সময় লাগছে। তাই ভাই স্ত্রী ও ছেলেকে বাইকেই নিয়ে যাচ্ছিল। রাস্তাটা ঠিক থাকলে, ভাল থাকলে হয়তো দু’জনকে এভাবে অকালে চলে যেতে হত না।”
বস্তুত, দু’সপ্তাহ ধরে রায়গঞ্জের পানিশালা থেকে ডালখোলা ৪০ কিলোমিটার জাতীয় সড়কে দিনভরই তীব্র যানজট থাকছে। এপ্রিল মাস থেকে জাতীয় সড়ক বেহাল। পিচের চাদর উঠে গিয়ে চষা জমির চেহারা নিয়েছে। দক্ষিণবঙ্গ তথা দেশের বিভিন্ন রাজ্যের সঙ্গে উত্তরপূর্ব ভারতের সড়ক যোগাযোগের প্রধান ভরসা এই সড়ক। একেই বেহাল রাস্তা তার উপরে ভারি যানবাহনের চাপে গত দু’সপ্তাহ ধরে জাতীয় সড়ক চলাচলের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। সম্প্রতি পাওয়ারহাউস এলাকায় জাতীয় সড়ক কর্তৃপক্ষ রায়গঞ্জগামী বেহাল রাস্তার একটি অংশে মেরামতি শুরু করেছেন। প্রায় আট ফুট চওড়া ওই রাস্তাটির চারফুটে পিচের প্রলেপ পড়লেও বাকি চারফুটে কোনও কাজ এখনও না হওয়ায় রাস্তাটির বিভিন্ন অংশ খানাখন্দ রয়েছে। পুলিশ সূত্রের খবর, গত ছয় মাসে জাতীয় সড়কে বাস ও ট্রাক মিলিয়ে প্রায় ৬৫০টি গাড়ি বিকল হয়েছে। পথ দুর্ঘটনায় আট জনের মৃত্যু হয়েছে।
সৈয়দপুর থেকে বাইকে চেপে বোতলবাড়ি হয়ে কালুয়াবাবু স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে রায়গঞ্জের দিকে যাচ্ছিলেন। ওই রাস্তায় সৈয়দপুর থেকে রায়গঞ্জের দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার হলেও তারমধ্যে প্রায় ১৫ কিলোমিটার জাতীয় সড়ক রয়েছে। সেটি চলাচলের একেবারে অযোগ্য হয়ে পড়েছে বলে বাসিন্দাদের অভিযোগ। দুর্ঘটনার পর বাসিন্দারা ট্রেলারটি আটক করলেও চালক পালিয়ে যায়। দ্রুত জাতীয় সড়ক মেরামতির দাবিতে ঘণ্টা দু’য়েক অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখান বাসিন্দারা। পরে পুলিশের আশ্বাসে অবরোধ ওঠে।
দুর্ঘটনার পর জাতীয় সড়কের উপরেই স্ত্রী ও ছেলের মৃতদেহ জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন কালুয়াবাবু। তাঁর আর্তচিৎকারে আশপাশের লোকজনও চোখের জল ধরে রাখতে পারছিলেন না। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলছিলেন, “ছেলেকে আর চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হল না। স্ত্রীও চিরদিনের মত চলে গেল। কী করব জানি না। নিজেকে ক্ষমা করতে পারছি না। আমি কেন থেকে গেলাম?” এটুকু বলেই শোকে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন কালুয়াবাবু। পুলিশ, পরিবার এবং এলাকার লোকজন এগিয়ে এসে কোনওক্রমে তাঁকে সামলায়। |