|
|
|
|
|
|
|
পুস্তক পরিচয় ১... |
|
নিঃশব্দে অনেক চিন্তা উস্কে দেন |
গৌতম চক্রবর্তী |
আত্মহত্যার অধিকার এবং অন্যান্য সনদ, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিভাস, ৪০০.০০
বাস্তবের কুহক কুহকের বাস্তব, মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিভাস, ৩০০.০০ |
বাংলায় তিন জন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। এক জন ক্রিকেটার সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাদা, ছোটদের জন্য ক্রিকেটের গল্প থেকে জুল ভের্ন অনুবাদ সবেতেই সিদ্ধহস্ত। দ্বিতীয় মানবেন্দ্র দক্ষ অনুবাদশিল্পী। তাঁর হাত ধরেই কৃষণচন্দর, গিরিশ কারনাড থেকে বরিস পাস্তেরনাক, লোরকা, গার্সিয়া মার্কেজ, পিটার বেকসেল অনেকে নাড়া দিয়েছেন বাংলা সংস্কৃতিকে। তৃতীয় জন তুলনামূলক সাহিত্যের জনপ্রিয় অধ্যাপক। তাঁর সৌজন্যেই নোবেল প্রাপ্তিরও আগে মার্কেজ ঢুকে আসেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে, চিলের কবি নিকানার পাররা ছাত্রদের সামনে অ্যান্টি পোয়েট্রি বা প্রতিকবিতা নিয়ে বক্তৃতা দেন। আলোচ্য বই দুটি শিশুসাহিত্যিক, অনুবাদক এবং উইটি অধ্যাপক... তিন অবতারকে এক যোগে মলাটবন্দি করেছে। বাস্তবের কুহক কুহকের বাস্তব মুখ্যত লাতিন আমেরিকার লেখক ও ‘ম্যাজিক রিয়ালিজ্ম’ ঘরানা নিয়ে প্রবন্ধসংগ্রহ। আত্মহত্যার অধিকার বইয়ে আবার লাতিন আমেরিকার পাশাপাশি নাইজিরিয়ার ওলে সোয়েঙ্কা, সুদানের তায়েব সালিহ থেকে জঁ জেনে, টারজান, বুদ্ধদেব বসুর শিশুসাহিত্য, শিবরাম চক্রবর্তী, অন্নদাশঙ্কর রায়ের ছড়া পাশাপাশি। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত এই লেখাগুলি একত্র হাতে আসাই পরম প্রাপ্তি। তবে দুটি বই-ই পুরনো নিবন্ধের সংগ্রহ, ফলে মাঝে মাঝে গোল বেধেছে। নোবেলজয়ী মারিও ভার্গাস য়োসাকে নিয়ে ‘জলের মধ্যে একটি মাছ’, এদুয়ার্দো গালেনোকে নিয়ে ‘প্রবন্ধের অন্য সাজ’ এবং ‘বাস্তবের কুহক’, তিন প্রবন্ধই দুই সঙ্কলনে! বাস্তবের কুহক বইতে আরহেন্তিনার ম্যানুয়েল পুইগ, চিলের আন্তোনিও স্কারমেতা ও পেরুর ভার্গাস য়োসাকে নিয়ে দুটি করে প্রবন্ধ। এবং প্রায় একই কথা। বাস্তবের কুহক বইয়ের উপ-শিরোনাম ‘লাতিন আমেরিকার সাম্প্রতিক কথাসাহিত্য’ নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলতে পারেন। সেই গার্সিয়া মার্কেজ, ভার্গাস য়োসা, হুয়ান রুলফো! কেন নেই চিলের রোবার্তো বোলানো, কিংবা রেড এপ্রিল উপন্যাসের লেখক, পেরুর সান্তিয়াগো রোনকোগলিও? এই প্রশ্ন নিরর্থক। বাংলা কবিতার সাম্প্রতিক কোনও সঙ্কলনে কি আসবেন না জীবনানন্দ, শক্তি চট্টোপাধ্যায় বা বিনয় মজুমদার? আধুনিকতায় বর্তমান-অতীত সব স্পাইরাল ভঙ্গিতে জড়িয়ে থাকে। ছয় প্রজন্ম পরে বোঝা যায়, বেদে মেলকুয়াদিস সংস্কৃত ভাষায় লিখে গিয়েছে মাকোন্দো জনপদের কাহিনি।
কাকে বলে সাম্প্রতিক? আত্মহত্যার অধিকার এবং অন্যান্য সনদ বইয়ে ‘শিল্পীর সঙ্কট: দুটি চিঠি’ নিবন্ধটি উল্লেখ্য। তিরিশের দশকে হিটলারের জার্মানি। টমাস মান, হেরমান হেস, বের্টোল্ট ব্রেখ্ট দেশছাড়া। কবি গটফ্রিড বেন দেশ ছাড়েননি, বার্লিন থেকে তাঁর চিঠি, ‘শ্রমিকরা এখন আগের চেয়ে ঢের ভাল ব্যবহার পায়। সুপারভাইজার এবং কর্তৃপক্ষ অনেক ভদ্র। সোস্যালিস্ট পার্টি যা দিতে পারেনি, জাতীয়তাবাদী সমাজবাদ তাই দিয়েছে। যারা বলে, হিটলারের পিছনে জনগণ নেই, আছে ভেড়ার পাল, তারা মিথ্যাবাদী।... সাহিত্যিককেও বেছে নিতে হয়, তিনি কী নেবেন। ব্যক্তিগত খেয়ালখুশি, না রাষ্ট্রাভিমুখী গতিপথ। আমি বেছে নিয়েছি দ্বিতীয়টা।’ এর পরই মানববাবু দেখান কয়েক বছর পর টমাস মানের লেখা চিঠি। মহাযুদ্ধের শেষে আমেরিকার বাসিন্দা টমাস মানকে ফিরে আসার কাতর অনুনয় করে জার্মান লেখক ও শিল্পীরা চিঠি লেখেন। মানের উত্তর, ‘যা কিছু ঘটেছে, যেমন ভাবে ঘটেছে, তা নিশ্চয় আমার কৃতকর্ম নয়। জার্মান চরিত্রেই অনিবার্য ফল ওটা। জার্মান জাতির নিয়তি।’ মানুষের স্বাধীনতার স্পন্দন, বেঠোফেনের ‘ফিডেলিয়ো’ নাৎসি শাসকদের তখন প্রিয়। বাদকেরা সেই সুর বাজান, লোকে ভিড় করে শোনে। মানের চিঠি, ‘‘হিটলারের জার্মানিতে ‘ফিডেলিয়ো’ শোনার মতো চরম নির্বুদ্ধিতা আমি কল্পনা করতে পারি না।’’ |
|
কিংবা ‘আত্মহত্যার অধিকার’ প্রবন্ধটি! রবীন্দ্রনাথের পাশে জগদীশ গুপ্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কেও নিয়ে আসেন লেখক। ব্যর্থ প্রেমের আত্মধ্বংস নয়, শুধুই অকারণ আত্মহত্যা। এখানেই লেখকের চমৎকারিত্ব। নিঃশব্দে অনেক চিন্তা উস্কে দেন। ‘চেতন স্যাকরা’য় অপু-দুর্গারও তফাত করে দেন! চেয়েচিন্তে, চুরি করে সোনার কৌটো, ছেঁড়া পুতুল কত কী জমাত দুর্গা! সঞ্চয় বলে অপুর কিছু ছিল না। তবু তারই কাছে সব কিছু জমা হয়ে রইল লুকনো, গোপন ও বেদনাকরুণ। পড়ে নিতে পারেন ‘অনুবাদ, প্রমাদ ও প্রমোদ।’ মানববাবু জানান, লেখককে সংস্কৃত ও সভ্য করে তুলতে হবে। অনুবাদে জুড়ে দিতে হবে সাহেবদের পণ্ডিতি। ইউনেস্কো-র পথের পাঁচালী-র অনুবাদে তাই প্রথম লাইন, Harihar Ray was a brahmin।
এই ঝাঁজালো মেধার সঙ্গেই তো তর্ক করা যায়! বাস্তবের কুহক বইয়ে লাতিন আমেরিকার অনেক লেখককে নিয়ে নিবন্ধ। বোর্হেসকে নিয়ে একটিও নিবন্ধ নেই কেন? নিবন্ধকার বোর্হেসের কলাকৈবল্যবাদ পছন্দ করেন না। আর, বোর্হেসও ‘ম্যাজিক রিয়ালিজ্ম’ পছন্দ করতে পারেননি। এই অপছন্দ নিয়েই তো হতে পারত নিবন্ধ। কিংবা সন্ধান করা যেত, কেন এক সময় বোর্হেসবিরোধী হয়েও নোবেলভাষণে তাঁকেই স্মরণ করেন মারিও ভার্গাস য়োসা। কার্লোস ফুয়েন্তিস-ই বা কেন লাতিন আমেরিকার গল্প সঙ্কলন তৈরি করতে গিয়ে প্রথমেই রাখেন বোর্হেসের গল্প?
পর্তুগালের নোবেলজয়ী হোসে সারামাগোকে নিয়ে লেখাটি যেমন! লেখকের মৃত্যুর পর ফিদেল কাস্ত্রোর শোকবার্তার কথা উল্লেখ করেছেন মানববাবু। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, সারামাগো মৃত্যুর কয়েক মাস আগে তুমুল ক্ষোভে বলেছিলেন, ‘কমিউনিস্টরা আজকের দুনিয়ার কিচ্ছু জানে না।’ তার পর দুঃখ করেছিলেন, ‘এত বলার পরও পার্টি কিছুই জানতে চায় না।’ উম্বের্তো একো পরে ঠাট্টা করেছিলেন, ‘সারামাগো কি আশা করেন, পার্টি ওঁকে তাড়িয়ে দেবে?’ এই ঘটনা মানববাবুর লেখায় নেই।
ভার্গাস য়োসার দক্ষিণপন্থী বনে-যাওয়া নিয়েও মানববাবুর আক্ষেপ। ঘটনা, ২০১০ সালে নোবেল-বক্তৃতায় কিউবা নিয়ে মোহভঙ্গের কথা বলার পাশাপাশি আমেরিকার ইরাক আক্রমণের নিন্দাও করেছিলেন য়োসা। মার্কেজের নোবেল বক্তৃতার পাশাপাশি তাঁর নোবেল-বক্তৃতার অনুবাদও এমন বইতে থাকতেই পারত!
দুটি বইতেই বেশ ছাপার ভুল। পর্তুগালের রাজধানী লিসবোয়া এক জায়গায় হয়েছে নিসবোয়া। ভার্গাস য়োসার ডাকনাম কোথাও ভার্গিতা, কোথাও বা বার্গিতা। দুটি সংকলনের কোথাও সম্পাদনার চিহ্ন নেই। কোনও লেখা তিন দশক আগের, কোনওটা সাম্প্রতিক। কোনটা কবে, কোথায় বেরিয়েছিল সেই তথ্য থাকবে না এমন গুরুত্বপূর্ণ দুটি সংকলনে? চিলে, পেরু বা নিকারাগুয়া যে কোনও দেশের লেখককে নিয়ে আলোচনার শুরুতেই মানববাবু জানিয়ে দেন, সেই দেশের ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনীতি, জনবসতি। এর সঙ্গে মানচিত্র দেওয়া যেত না? বাংলা সাহিত্য যদি সচেতন হত, মানববাবু অক্লেশে ছাড়িয়ে যেতেন ইংরেজিতে মার্কেজ-অনুবাদক গ্রেগরি রাবাসা বা ভার্গাস য়োসা-অনুবাদক এডিথ গ্রোসমানকে। রাবাসা বা এডিথ শুধুই অনুবাদক। কিন্তু মানববাবু সাহিত্যসন্দর্ভ রচনায় লাতিন আমেরিকান গল্পের পাশেই অক্লেশে রেখে দেন মহাশ্বেতা দেবীর ‘বসাই টুডু’কে। মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় অনূদিত ভাৎস্লাভ হাভেলের ‘মনঃসংযোগের ক্রমবর্ধমান অসুবিধা’ বা লোরকার ‘বার্নান্দো আলবার সংসার’-এর মতো নাটক বহু দিন ধরেই দুষ্প্রাপ্য। উপযুক্ত সম্পাদনাসহ নাটকগুলি দুই মলাটে প্রকাশ করা যায় না? |
|
|
|
|
|