হাই-মাদ্রাসায় ইংরাজি মাধ্যমে শিক্ষার প্রচলন এই রাজ্যে এই প্রথম হইতে চলিয়াছে নদিয়া জেলার চাপড়া এলাকার প্রত্যন্ত গ্রাম পানিনালায়। সিদ্ধান্ত আগেই হইয়াছিল। বস্তুত, বিগত বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই রাজ্যের সব কয়টি জেলায় অন্তত একটি করিয়া ইংরাজি মাধ্যমের হাই-মাদ্রাসা চালু করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু সিদ্ধান্ত কার্যকর করিবার কৃতিত্বটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের। ইংরাজি যে পশ্চিমের ভাষা নয়, ভাষার যে পূর্ব-পশ্চিম নাই, ইংরাজি না জানিলে কাজের জগতে, চাকুরির বাজারে করিয়া খাওয়ার সম্ভাবনাও ক্ষীণ হইয়া পড়ে, এই সব উপলব্ধি হইতেই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মনে ইংরাজি শিক্ষার প্রতি আগ্রহের সূচনা। এই আগ্রহ ইতিবাচক।
মাদ্রাসা শিক্ষা সম্পর্কে বিস্তর ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত। যথা, মাদ্রাসায় কেবল সংখ্যালঘু ছাত্ররাই পড়ে এবং সেখানে কেবল ধর্মশিক্ষাই দেওয়া হয়। প্রথমত, সংখ্যালঘু ছাত্রছাত্রীর মাত্র চার শতাংশই মাদ্রাসায় পড়ে, বাকিরা রাজ্যের মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিক স্কুলেই পাঠরত। গ্রাম-বাংলার মাদ্রাসাগুলিতে নিম্নবর্গীয় পড়ুয়াদের ভিড়ই বেশি। দ্বিতীয়ত, ১০০ নম্বরের আরবি পাঠ্যক্রম ছাড়া মাদ্রাসার আর সব শিক্ষাক্রমই রাজ্যের মাধ্যমিক, উচ্চ-মাধ্যমিক স্কুলের অনুরূপ। নদিয়ার চাপড়ায় যে হাই-মাদ্রাসা চালু হইতে চলিয়াছে, সেখানেও ইংরাজি মাধ্যমের শিক্ষকের অভাব মেটানো হইবে অন্যান্য হাই-মাদ্রাসা হইতে শিক্ষক আমদানি করিয়া। কেন এই হাই-মাদ্রাসায় পঞ্চম শ্রেণির পরিবর্তে প্রথম শ্রেণি হইতেই শিক্ষার মাধ্যম ইংরাজি হইবে? লেখাপড়ার সূত্রপাতটাই ইংরাজি মাধ্যম দিয়া করাইবার তাগিদ এ ক্ষেত্রে সক্রিয়, যাহাতে চতুর্থ শ্রেণি অবধি কেবল মাতৃভাষার মাতৃদুগ্ধ সেবন করিয়া পঞ্চম শ্রেণিতে উঠিয়া ইংরাজি মাধ্যমে হিমশিম খাওয়ার দুর্বিপাক এড়ানো যায়।
ইহা সূচনামাত্র। প্রতি জেলায় একাধিক ইংরাজি মাধ্যম মাদ্রাসা চালু করিতে হইবে। যে পাঁচ শতাধিক হাই-মাদ্রাসা রাজ্যে রহিয়াছে, ক্রমে সেগুলির অধিকাংশতেই ইংরাজি মাধ্যমে শিক্ষা প্রবর্তন হইলে ভাল। প্রস্তুতি, পরিকাঠামো, প্রশিক্ষক তৈয়ারি— সবই সময়সাপেক্ষ। কিন্তু সদিচ্ছাটুকু জরুরি। সংখ্যালঘুদের প্রকৃত উন্নয়নের চাবিকাঠি নিহিত রহিয়াছে আধুনিক, বিজ্ঞানসম্মত শিক্ষায় শিক্ষিত করিয়া প্রতিযোগিতার বাজারে নামার যোগ্যতায় মণ্ডিত করার প্রয়াসের মধ্যে। সংখ্যালঘু উন্নয়ন বলিতে সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অভিভাবকদের স— ভাতা প্রদান বুঝায় না, ইমাম ও মুয়েজ্জিনদের উৎকোচে বশীভূত করাও নয়। তাহাতে হয়তো সংখ্যালঘুর ভোট পাওয়ার জন্য সম্প্রদায়ের ধর্মীয় নেতাদের দ্বারস্থ হওয়া যায়। কিন্তু সংখ্যালঘু সমাজ যে-তিমিরে, সেই তিমিরেই পড়িয়া থাকে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানের পরিকাঠামো গড়িয়া তোলাতেই সংখ্যালঘু উন্নয়নের সার নিহিত। পড়ুয়াদের রকমারি বৃত্তি দিয়া অধ্যয়নে উৎসাহিত করা, দরিদ্র ছাত্রীদের সাইকেল বিলি করিয়া স্কুলে যাতায়াতের সময়সংক্ষেপের চেষ্টা করার মতো প্রকল্পগুলি নিঃসন্দেহে সেই উন্নয়নের এক একটি সোপান। সেই সঙ্গে ইংরাজি মাধ্যমে শিক্ষার প্রচলন, বিজ্ঞান-শিক্ষার উপর জোর দেওয়া, বিজ্ঞানমনস্কতা ও অন্ধ কুসংস্কারবিরোধী চেতনার বিকাশ ঘটানো, বৃত্তিশিক্ষার ব্যাপক আয়োজন, আবাসিক শিক্ষার সুযোগ বৃদ্ধি করাও কাম্য। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই ক্ষেত্রটিতে ঠিক দিশায় পদক্ষেপ করিতেছেন। বিলম্বিত পদক্ষেপ, তবে জরুরি। |