|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
যেখানে প্রাধান্য পায় শিল্পের সঙ্গে মানবিক দায়বোধ |
সিমা-তে চলছে ‘ট্রানজিশন’ শীর্ষক সম্মেলক প্রদর্শনী। ঘুরে এসে লিখছেন মৃণাল ঘোষ। |
আজ থেকে কুড়ি বছর আগে কলকাতায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল একটি ভিন্ন মানের শিল্পচর্চাকেন্দ্র, ‘সিমা’। ১৯৯০ থেকে ২০১৩ এই দুই দশকে বিশ্ব পরিস্থিতিতে স্বভাবতই বিপুল রূপান্তর ঘটেছে। ১৯৯৩-এর ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল সিমার প্রথম প্রদর্শনী। শিরোনাম ছিল ‘উন্ডস’ বা ‘ক্ষত’। প্রদর্শনীটি পরিকল্পিত হয়েছিল স্বাধীন ভারতে ঘটে যাওয়া এক জঘন্যতম উদ্দেশ্যপ্রণোদিত অপরাধের প্রতিবাদে। এর আগে ৬ ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংস করা হয়েছিল। সিমার সূচনায় ছিল শিল্পের সঙ্গে মানবিক দায়বোধকে যুক্ত করার প্রয়াস। ১৯৯০-এর দশকের বাজার অর্থনীতির অনুপ্রবেশ ও বিস্তার ভারতবর্ষের নৈতিক মূল্যবোধে যেমন বিপুল আলোড়ন এনেছে, তেমনই ২০০১-এর ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ঘটনা বিশ্বব্যাপ্ত সন্ত্রাসের চরিত্রে নতুন মাত্রার ভয়াবহতা সঞ্চার করেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার বৈপ্লবিক বিস্তার আমাদের দেশকে বিশ্বের সঙ্গে একাত্ম করেছে, কিন্তু তাতে আমাদের দুরাচার, দারিদ্র ও অশিক্ষার কোনও উপশম হয়নি। এই বাস্তবতার প্রকাশ ঘটছে আমাদের শিল্পকলায়। আজকের দৃশ্যকলা মূলত প্রতিবাদী, যান্ত্রিক-প্রযুক্তি-অধ্যুষিত এবং সাংকেতিক। যদিও একই সঙ্গে তা আধুনিকতার পূর্ববর্তী ঐতিহ্যকেও আত্মস্থ করছে।
জীবনের গভীর থেকে উঠে আসা এই শিল্প-প্রকাশ নিয়ে উপস্থাপিত হচ্ছে সিমার ২০ বছর উদযাপনের প্রদর্শনী, ‘ট্রানজিশন’। রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে আজকের তরুণতম শিল্পী মোট ৪০ জনের চিত্র, ভাস্কর্য, ইনস্টলেশন নিয়ে এই প্রদর্শনী। |
|
শিল্পী: জয়া গঙ্গোপাধ্যায়। |
আমাদের আধুনিকতাবাদী চিত্রকলার প্রথম পথিকৃৎ রবীন্দ্রনাথ। ১৯৩৫-এর ১৪ ফেব্রুয়ারি আঁকা তাঁর একটি রহস্যময়ী নারী-মুখাবয়ব দিয়ে এই প্রদর্শনীর শুরু। এই অন্তর্দীপ্ত, একই সঙ্গে ব্যক্তিগত ও মহাজাগতিক বিষাদ প্রযুক্তি-অধ্যুষিত আজকের জীবনে কোথায় এসে পৌঁছেছে তার একটি দৃষ্টান্ত তরুণ শিল্পী দেবাশিস বারুই-এর একটি ইনস্টলেশন, ‘কসমিক কনভার্সেশন’। দু’টি ছিন্ন পা বিপরীতমুখী শায়িত রয়েছে। মাঝখানে একটি ধাতব বৃত্ত স্থাপিত, যা সেন্সরের সক্রিয়তায় মোটরের সাহায্যে ঘূর্ণায়মান হয় যখনই কোনও মানুষ বা বস্তু তাঁর নিকটবর্তী হয়। এই ঘূর্ণনের ফলে সক্রিয় হয়ে ওঠে যে আলো ও ধ্বনি, তাতে মহাজাগতিক রহস্যময়তা আরোপিত হয়েছে। কিন্তু তা ছুঁয়ে যাচ্ছে যে ছিন্ন পদযুগলকে তা তো নিঃসীম মানবিক বিপর্যয়ের প্রতীক। সুমিত্র বসাকের প্লাস্টিক পুতুল দিয়ে গড়া বিকল্প রীতির চিত্র ‘আমার দেশ’, সমীর আইচের ‘ওয়েক আপ’ রচনায় ভূপতিত বিপর্যস্ত প্রায় বিমূর্ত মানব-প্রতিমা বা রশমি বাগচি সরকারের কণ্টকাকীর্ণ বালিশে জেগে ওঠার আহ্বান সবই সেই গহন শূন্যতার বিভিন্ন প্রতীক। জয়া গঙ্গোপাধ্যায়ের রচনাটিও সে ভাবেই দেখায় মাত্রাতিরিক্ত আসক্তি আজকের জীবনকে কোন অন্ধকারে নিয়ে যাচ্ছে।
এই শূন্যতার বিপরীতে সদর্থক এক বিশ্বাসের পরিসরও কিন্তু রয়ে গেছে, বিজ্ঞান বা প্রযুক্তি দিয়ে যার ব্যাখ্যা হয় না। লৌকিক ও উপজাতীয় শিল্পে এর নিদর্শন এখনও সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যায়নি। এরই দৃষ্টান্ত ওড়িশার শিল্পগুরু অনন্ত মহারাণার রামায়ণের হনুমানের রূপায়ণটি। পুরাণকল্পময় বিশ্বাস থেকেই যেমন রচিত হতে পারে কে জি সুব্রহ্মণ্যমের ছবিগুলি, বা রামকুমারের ১৯৯০তে আঁকা লৌকিক দুর্গা, তেমনই জয়শ্রী বর্মনের ‘বলাকা’ ব্রোঞ্জ ভাস্কর্যও।
সোমনাথ হোরের ‘রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক ব্রোঞ্জ-মুখাবয়বটিতে (১৯৯৮) মহাজাগতিক চেতনাসম্পন্ন বিশ্বকবির অনন্ত বিষাদ প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। মীরা মুখোপাধ্যায়ের ‘গঙ্গা’ (১৯৮৬) নদীস্রোতের প্রাণময়তাকে ভাস্কর্যে রূপবদ্ধ করেছে। সুকুমার দত্তের ‘গণেশ’ (১৯৯৪) লৌকিককে আধুনিকতায় আত্তীকরণের প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। জনক ঝংকার নার্জারির ইস্পাতে তৈরি ‘দ্য এনার্জি’ (২০১৩) স্থাপত্য ও ভাস্কর্যকে সমাহৃত করেছে। পঙ্কজ পাওয়ারের কাঠের রচনা ‘ব্যাটল অব অ্যাঞ্জেলস’ (২০১৩) জাদুবাস্তবতাকে কল্পরূপান্বিত করেছে। চিন্তন উপাধ্যায়ের ফাইবার গ্লাসের ‘ক্লাউড’ (২০১১) বিস্ফোরণের ধূম্রকুণ্ডলির মতো শূন্যে ভাসমান একটি রচনা। সুষেণ ঘোষের ‘স্পেস অ্যারাউন্ড’ ও ‘চেঞ্জেস অব মুডস’ (২০১৩) অসামান্য দৃষ্টান্ত।
অর্পিতা সিংহ ও লোকচিত্রী স্বর্ণ চিত্রকরের দ্বৈত রচনাটি আজকের সভ্যতায় মেলবন্ধনের বার্তা আনে। |
|
|
|
|
|