বিপুল দেনার দায় থেকে রাজ্যকে মুক্ত করতে চতুর্দশ অর্থ কমিশনের কাছ থেকে আড়াই লক্ষ কোটি টাকা অনুদান চেয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই আর্জির পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্য সরকারকে চিঠি দিয়ে সাতটি বিষয়ে তাদের অবস্থান জানতে চেয়েছে কমিশন। কমিশনের এই প্রশ্নাবলিকে ইতিবাচক বলেই মনে করছে রাজ্যের অর্থ দফতর। খুব শীঘ্রই কমিশনের প্রশ্নের উত্তর পাঠিয়ে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র।
গত ১৪ নভেম্বর কলকাতায় এসে নিউ টাউনের হিডকো ভবনে মুখ্যমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী-সহ রাজ্য সরকারের কর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন অর্থ কমিশনের চেয়ারম্যান ওয়াই বি রেড্ডি। তাঁর সঙ্গী ছিলেন প্রাক্তন ব্যয়সচিব সুষমা নাথ এবং রাজ্যের আর্থিক সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ সেন। সেই বৈঠকে রাজ্যের তরফে বলা হয়, রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য ভাবে বাড়ানো সত্ত্বেও বাম আমলে তৈরি হওয়া বিপুল ঋণের বোঝার কারণে উন্নয়নের কাজ আটকে যাচ্ছে। এই অবস্থায় রাজ্যের আর্থ-সামাজিক এবং পরিকাঠামো উন্নয়নে ২ লক্ষ ৫৫ হাজার কোটি টাকা অনুদান দরকার। বৈঠকের পরে অমিতবাবু দাবি করেছিলেন, রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির জন্য কমিশন এক দিকে যেমন রাজ্যের প্রশংসা করেছে, অন্য দিকে তেমনই স্বীকার করে নিয়েছে যে এত পরিমাণ ঋণের বোঝা আর কোনও রাজ্যের ঘাড়ে নেই।
সেই বৈঠকের পাঁচ দিন পরেই, ১৯ নভেম্বর কমিশনের সচিব এ এন ঝা রাজ্যকে চিঠি (ডিও নম্বর: ১১০১৩/ ৪০/১৩/ এফএফসি/এসএফসি-III) দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন, আর্থিক অনুদানের দাবি সহানুভূতির সঙ্গেই বিবেচনা করা হচ্ছে। তবে সাতটি বিষয়ে রাজ্যের অবস্থান আরও স্পষ্ট করে জানা প্রয়োজন।
|
সাত সওয়াল |
• বকেয়া ঋণ শোধে রাজস্ব আদায় বাড়ানো হবে কী ভাবে
• কোন পথে বাড়ানো হবে কর আদায়ও
• আগামী পাঁচ বছর ব্যয় নিয়ন্ত্রণে কী কী পদক্ষেপ
• অধিগৃহীত সংস্থার সংস্কারের উদ্যোগ কী কী
• জঙ্গলমহল, সুন্দরবন উন্নয়নে কী পরিকল্পনা
• কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি নিয়ে পরিকল্পনা কী
• কী ভাবে খরচ হয়েছে ত্রয়োদশ অর্থ কমিশনের টাকা |
|
এই সাতটি বিষয় হল, • প্রায় দু’লক্ষ কোটি টাকা ঋণ পরিশোধের ব্যাপারে রাজ্য সরকারের পরিকল্পনা কী? কোন পথে রাজস্ব আদায় বাড়িয়ে এই ঋণ শোধ করা হবে? • রাজস্ব আদায় বাড়ানোর পাশাপাশি ২০১৫-’১৬ আর্থিক বছর থেকে ২০১৯-’২০ আর্থিক বছর পর্যন্ত (অর্থাৎ চতুর্দশ অর্থ কমিশনের মেয়াদ কালে) ব্যয় সঙ্কোচের কী পরিকল্পনা নিয়েছে রাজ্য? এ ব্যাপারে তাদের নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা কী? • রাজ্যের হাতে যে ৫৩টি অধিগৃহীত সংস্থা রয়েছে সেগুলি সংস্কার করতে এবং লাভজনক ভাবে চালাতে রাজ্য সরকারের পরিকল্পনা কী? • রাজ্যের পিছিয়ে পড়া জঙ্গলমহল, সুন্দরবন এবং চা-বাগান এলাকার উন্নয়নের জন্য সরকারের ভাবনা কী? • রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের জন্য বেতন কমিশন গঠন এবং তাঁদের বেতন বৃদ্ধির ব্যাপারে পরিকল্পনা কী? • রাজ্যের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের তুলনায় কর আদায়ের পরিমাণ বেশ কম। সেই হার বাড়াতে কী পদক্ষেপ করা হচ্ছে? এবং • ত্রয়োদশ অর্থ কমিশনের কাছ থেকে পাওয়া টাকা কী ভাবে খরচ করা হয়েছে?
চটজলদি কমিশনের কাছ থেকে সাড়া পেয়ে রীতিমতো খুশি রাজ্যের অর্থ দফতর। অর্থমন্ত্রী বলেন, “আমরা খুশি কারণ, রাজ্য যে বিষয়গুলিতে গুরুত্ব আরোপ করেছিল, অর্থ কমিশন সেগুলি নিয়েই ব্যাখ্যা তলব করেছে। ফলে উন্নয়ন খাতে অনুদান এবং ঋণ মকুব, দুই ক্ষেত্রেই কমিশন ইতিবাচক পদক্ষেপ করবে বলে মনে হচ্ছে।” কমিশন যে যে ক্ষেত্রে অবস্থান স্পষ্ট করতে বলেছে, তা খুব শীঘ্রই বিশদে তাদের জানিয়ে দেওয়া হবে বলে অমিতবাবু জানান। তিনি বলেন, এর পরেও যদি কমিশনের আর কিছু জিজ্ঞাস্য থাকে, তা হলে তার জবাব দিতেও রাজ্য তৈরি।
কমিশনের চিঠি পেয়ে ইতিমধ্যেই জবাব তৈরির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন অর্থ দফতরের কর্তারা। এক কর্তা বলেন, “পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য আমরা ১ লক্ষ কোটি টাকা চেয়েছি। যার বেশির ভাগটাই পশ্চিমাঞ্চল, সুন্দরবন এবং উত্তরবঙ্গের চা-বাগান এলাকার জন্য। এ বার বিস্তারিত ভাবে এলাকা ধরে ধরে উন্নয়ন পরিকল্পনার কথা জানানো হবে। এ ছাড়া, ৪১টি দফতরের জন্য ১ লক্ষ ৫৫ হাজার কোটি টাকার অনুদান চাওয়া হয়েছে। সরকারের ব্যয়ের মুখ যে মূলত উন্নয়নের জন্যই, এটা তারই প্রমাণ। সুতরাং খরচখরচা নিয়ে যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, তার উত্তর দিতেও আমরা প্রস্তুত।”
ঋণের বোঝা কমাতে অর্থ কমিশনের সহায়তা দরকার জানিয়ে ওই কর্তারা বলেন, সেই কারণেই ১৪ হাজার কোটি টাকার কেন্দ্রীয় ঋণ মকুব এবং ঋণ শোধের মেয়াদ ১০ থেকে বাড়িয়ে ১৫ বা ২০ বছর করার দাবি করা হয়েছে কমিশনের কাছে। সেই কথাই ফের বলা হবে। জানানো হবে, এই বিপুল পরিমাণ ঋণ রাজ্যের নিজস্ব করের টাকায় শোধ করা সম্ভব নয়। এক কর্তার কথায়, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে ঋণ শোধে তিন বছরের স্থগিতাদেশ চেয়ে বারবার কেন্দ্রের কাছে দরবার করা হয়েছে। কিন্তু কেন্দ্র কর্ণপাত করেনি। এখন অর্থ কমিশন তার সুপারিশে ঋণ মকুবের উপায় বাতলালে এ ব্যাপারে নতুন দিশা দেখা যাবে।”
তবে সরকারি কর্মচারীদের বেতন বৃদ্ধি সংক্রান্ত প্রশ্নের মুখে রাজ্য কিছুটা বিব্রত বলে অর্থ দফতরের কর্তাদের একাংশের দাবি। আর কিছু দিনের মধ্যেই সপ্তম বেতন কমিশন গঠনের কথা ঘোষণা করবে কেন্দ্র। ২০১৬-র ১ জানুয়ারি থেকে কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীরা বর্ধিত বেতন পাবেন বলে খবর। সাধারণ রীতি অনুযায়ী কেন্দ্র বেতন কমিশন গঠন করার পরে রাজ্যও নিজস্ব বেতন কমিশন গঠন করে। কেন্দ্রের তরফে ইতিমধ্যেই রাজ্যের কাছে তাদের পরিকল্পনার কথা জানতে চাওয়া হয়েছে। রাজ্য কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রককে জানিয়ে দিয়েছে, কর্মচারীদের বেতন বাড়াতে তাদের কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু বর্তমান আর্থিক পরিস্থিতিতে তাদের পক্ষে বাড়তি কোনও আর্থিক দায় বহন করা সম্ভব নয়। ফলে কেন্দ্র বর্ধিত বেতনের দায় নিলে কমিশন গড়তে তাদের আপত্তি নেই।
বর্ধিত বেতনের পাশাপাশি বকেয়া মহার্ঘভাতার দায়ও কেন্দ্রের ঘাড়েই চাপাতে চায় রাজ্য। কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীরা এই মুহূর্তে ৯২ শতাংশ ডিএ পান। জানুয়ারি থেকে ৬ শতাংশ ডিএ পেলে রাজ্য সরকারি কর্মচারীদের প্রাপ্তির পরিমাণ হবে ৫৮ শতাংশ। ফলে ফারাকের পরিমাণ ৩৪ শতাংশ। নতুন বছরের গোড়ায় কেন্দ্র আরও এক কিস্তি ডিএ ঘোষণা করলে সেই ফারাক আরও বেড়ে যাবে।
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যেই জানিয়ে দিয়েছেন, বর্ধিত বেতনের মতো বকেয়া ডিএ দেওয়ার অবস্থায় রাজ্য নেই। এই ভার কেন্দ্রকেই নিতে হবে। কিন্তু এর পরেও বেতন বৃদ্ধি নিয়ে অর্থ কমিশনের প্রশ্ন রাজ্যের পক্ষে সুখবর নয় বলেই অর্থ দফতরের ওই কর্তাদের অভিমত। |