নামেই নির্দেশ, ছাই-ইট নিয়ে নির্বিকার সরকার
দেশের শীর্ষ আদালত বছর দশেক আগেই স্পষ্ট করে দিয়েছিল, তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের একশো কিলোমিটার পরিধির মধ্যে কোনও সাবেক ইটভাটা থাকা চলবে না। মাটি নয়, ওই এলাকায় ইট তৈরির জন্য ব্যবহার করতে হবে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাইয়ের মণ্ড।
তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলি থেকে নির্গত পাহাড় প্রমাণ ছাই-এর দূষণ রুখতে এবং একই সঙ্গে তা ফের ব্যবহারযোগ্য করে তুলতেই আদালতের এই দাওয়াই নিয়ে দেরিতে হলেও নড়েচড়ে বসেছিল সরকার।
বিজ্ঞপ্তি জারি করে পরিবেশ দফতরের নির্দেশ ছিল, সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ ‘অবশ্যই মান্য’ করতে হবে। মুর্শিদাবাদ, পুরুলিয়া, বীরভূম, পূর্ব মেদিনীপুর এবং বর্ধমান, পাঁচ জেলাকে এ ব্যাপারে বাড়তি সতর্কতা অবলম্বনের নির্দেশ দিয়ে চিঠি দিয়েছিলেন পরিবেশ সচিব। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর, দশ মাসে কয়েক দফায় নির্দেশ মেনে চলার ব্যাপারে জেলা পুলিশ ও ভূমি রাজস্ব দফতরকে নজরদারি চালাতেও বলেন চার জেলাশাসক। তবে তা নিছকই ‘নিয়মরক্ষার’। প্রশাসন সূত্রেই জানা গিয়েছে, ওই জেলাগুলিতে নতুন ইটভাটা চালু হওয়ার খবর মিলেছে। মুর্শিদাবাদের ‘ব্রিক ফিল্ড ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর কার্যকরি কমিটির সদস্য আব্দুল বারি শেখ খোলাখুলিই বলেন, “জেলার প্রায় সাতশো ইটভাটার অধিকাংশই বেআইনি। এ বছরও বেশ কয়েকটি নতুন ইটভাটা হয়েছে।” প্রায় একই তথ্য মিলেছে উত্তর ২৪ পরগনার ইটভাটা মালিকদের কাছেও। শুধু তাই নয়, হুগলি, হাওড়া, উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার মতো জেলাগুলিতেও কয়েক হাজার ইটভাটা থাকা সত্ত্বেও সেখানে অবশ্য কোনও সরকারি বিজ্ঞপ্তিই এ যাবৎ জারি করার প্রয়োজন মনে করেনি রাজ্য সরকার। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন মুখ্য আইন-অফিসার বিশ্বজিত মুখোপাধ্যায় দীর্ঘ দিন ধরে সুপ্রিম কোর্টের ওই নির্দেশ কার্যকর করতে লড়াই চালাচ্ছেন। তিনি বলেন, “সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, রাজ্যে অন্তত তিন হাজার ইটভাটা রয়েছে যাদের কাঁচামাল কৃষিজমির মাটি। প্রতিটি ইটভাটায় বছরে অন্তত ১০ লক্ষ ইট তৈরি হয়। এবং প্রতিটি ইটের জন্য প্রয়োজন প্রায় ৫ কেজি মাটি। অর্থাৎ হিসেব অনুযায়ী বছরে কৃষি জমি থেকে অন্তত সাড়ে সাতশো হাজার কেজি মাটি হারিয়ে যাচ্ছে ইটভাটার আগুনে।”
এ নিয়ে যে সতর্ক হওয়ার সময় এসেছে তা স্বীকার করেছেন পরিবেশ মন্ত্রী সুদর্শন ঘোষ দস্তিদার। তিনি বলেন, “এ ব্যাপারে জেলাশাসকদের নজরদারি বাড়াতে বলা হয়েছে।”
কিন্তু নজরদারির আড়ালে?
সরকারি পরিসংখ্যানই বলছে, প্রতি বছর দক্ষিণবঙ্গ থেকে প্রায় সাড়ে সাতশো কোটি কেজি মাটি নিশ্চুপে ট্রাক-বন্দি হয়ে পাড়ি দিচ্ছে রাজ্যের বিভিন্ন ইটভাটায়। পাশাপাশি, সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ মেনে উল্লেখিত জেলাগুলিতে ফ্লাই-অ্যাশ বা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে নির্গত ছাইয়ের ব্যবহারের বিশেষ কোনও সদগতি হয়নি। ফলে মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, বীরভূম কিংবা পুরুলিয়া জেলাতে অন্তত ৬৪টি ছাই-ইট তৈরির কারখানা থাকা সত্ত্বেও এখনও তাদের লাভজনক বাজার তৈরি হয়নি।
রাজ্যের ‘ফ্লাই অ্যাশ ব্রিকস অ্যান্ড ব্লকস ম্যানুফ্যাকচারিং অ্যাসোসিয়েশন’-এর সম্পাদক সুরজিত বসুর আক্ষেপ, “তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই দিয়ে তৈরি ইট শুধু মজবুত নয় দামেও সস্তা। এমনকী ফ্লাই অ্যাশের ইট তৈরির পদ্ধতিতে দূষণের মাত্রাও শূন্য। তবুও সাধারণ মানুষের মানসিকতা বদলায়নি। সরকারি উদ্যোগও নেই। ফলে সাবেক ইটের বাজারে আমরা কেউই দাঁত ফোটাতে পারিনি।”
দক্ষিণবঙ্গের ব্যান্ডেল, বজবজ, টিটাগড় থেকে বক্রেশ্বর, কোলাঘাট, মেজিয়া অধিকাংশ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ঘিরেই ইটভাটার রমরমা। কিছু দিন আগে সুদর্শনবাবু বিধানসভার বিদ্যুৎ বিষয়ক স্টান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান কেপি সিংহদেওকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে চিঠি দিয়েছেন। বিষয়টি জানানো হয়েছে শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্ট্যোপাধ্যায়কেও। সাড়া মেলেনি।
কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই যে ইট তৈরির কাজে লাগানো হচ্ছে না এ অভিযোগ বেশ কিছু দিন ধরেই জানিয়ে আসছেন স্থানীয় গ্রামবাসীরা। ওই তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে উড়ে আসা ছাইয়ে দূষণের বিরাম নেই। কোলাঘাট তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধ কমিটির সম্পাদক নারায়ণ নায়েক বলেন, “ছাই-দূষণে বহু মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্যদের কাছে এ ব্যাপারে স্মারকলিপিও জমা দিয়েছি। আমাদের দাবি, দূষণ যখন নিয়ন্ত্রণই করতে পারছেন না তখন এলাকার অসুস্থ মানুষজনের চিকিৎসার ভার নিতে হবে ওই তাপবিদ্যু কেন্দ্রকে।”
আর, সরকারি নির্মাণেও এই ইট ব্যবহার করা হয়না কেন? ছাই-ইটের কারবারিদের দাবি, মাটির ইটের বিভিন্ন রকমফের রয়েছে। সেখানে জালিয়াতিরও সুযোগ যথেষ্ট। ছাই-ইট সংগঠনের এক কর্তা বলেন, “সরকারি নির্মাণ কাজ করে থাকে বিভিন্ন ঠিকাদার সংস্থা। তারা সর্বোচ্চ মানের ইটের দাম নিয়ে নির্মাণের সময়ে ব্যবহার করে নিম্ন মানের ইট। এ ব্যাপারে সরকারি কর্মীদের একাংশও জড়িত। অন্য দিকে ছাই-ইটের কোনও রকমফের নেই। দামও বাঁধা। সেখানে চৌর্যবৃত্তির সুযোগ নেই।” তবে, এ ব্যাপারে মানসিকতাও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সরকারি সূত্রেই জানা গিয়েছে, ‘নতুন’ জিনিষ ব্যবহার করা নিয়ে বহু প্রশ্ন, সংশয় রয়ে গিয়েছে। তা অতিক্রম করার মানসিকতা এখনও তৈরিই হয়নি।
শীর্ষ আদালতের নির্দেশ তাই থমকে রয়েছে খাতায় কলমেই।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.