মাটির নীচের জলভাণ্ডার যত ক্ষয়িষ্ণু হবে, তত বাড়বে দূষণ। ভবিষ্যতে এমন একটা দিন আসতে পারে, যখন তৃষ্ণা মেটানোর জল জোটানোও দুষ্কর হয়ে পড়বে। এই হুঁশিয়ারি দিয়ে কৃষি ও অন্য কাজে ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার অবিলম্বে নিয়ন্ত্রণ করার পরামর্শ দিলেন বিশেষজ্ঞেরা।
বৃহস্পতিবার কলকাতায় জল সংরক্ষণ সংক্রান্ত এক আলোচনাচক্রে কেন্দ্রীয় ভূ-জল পর্ষদের অধিকর্তা গৌরাঙ্গচরণ পতি জানান, সেচে ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহারের নিরিখে পূর্ব ভারতে পশ্চিমবঙ্গের স্থান তৃতীয়। মাটির নীচ থেকে যথেচ্ছ জল তুলে নিলে আগামী দিনে পশ্চিমবঙ্গে পানীয় জলের আকাল দেখা দিতে পারে বলে সতর্ক করেছেন তিনি। শুধু তা-ই নয়, অন্য বিপদও আসতে পারে। “পশ্চিমবঙ্গের ভূগর্ভস্থ জলে আর্সেনিক ও ফ্লুওরাইডের দূষণ ছড়াচ্ছে। খুবই চিন্তার বিষয়। ভূগর্ভের জলস্তর যত নামবে, তত বাড়বে এই দুই দূষণ।” বলেন তিনি।
এই অবস্থায় বিপর্যয় এড়াতে ভূগর্ভের জল ব্যবহারে সচেতন হতে আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার তো সম্প্রতি গ্রামে সেচ-নলকূপ ব্যবহারের উপরে নিয়ন্ত্রণ তুলে দিয়েছে! এমনকী চাষিরা যাতে ভূগর্ভের জল আরও বেশি করে সেচের কাজে লাগাতে পারেন, সেই লক্ষ্যে সেচ-পাম্পে ভর্তুকির ব্যবস্থাও করা হয়েছে! এ নিয়ে তিনি কী বলছেন?
গৌরাঙ্গবাবুর জবাব, “ভূগর্ভস্থ জল সংশ্লিষ্ট রাজ্যের সম্পত্তি। তা ছাড়া রাজ্য সরকারের পৃথক ভূ-জল পর্ষদ রয়েছে। রাজ্যই সিদ্ধান্ত নেবে।” সঙ্কটের পিছনে তিনি শুধু কৃষি-সেচে ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহারকে দায়ী করতে নারাজ। কেন্দ্রীয় পর্ষদের অধিকর্তার কথায়, “দেশে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আসায় গেরস্থালির কাজেও মাটির নীচের জলের ব্যবহার বাড়ছে। ফলে ভাঁড়ারে টান পড়ছে।” নদী-বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র জানান, ফি বছর রাজ্যের ১৭৪টি ব্লকে ২০ সেন্টিমিটার করে জলস্তর নেমে যাচ্ছে। অন্তত সমীক্ষায় তা-ই ধরা পড়েছে বলে কল্যাণবাবুর দাবি।
পাতাল-জলের ভাণ্ডারে এ হেন দুর্দশার ছবি স্পষ্ট কেন্দ্রীয় ভূ-জল পর্ষদের তথ্যেও। তা অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের ৩৮টি জেলায় ভূগর্ভস্থ জলস্তর আধা-সঙ্কটাপন্ন (সেমি ক্রিটিক্যাল)। সেখানে জলস্তরের ঘাটতি পূরণ না-হলে বিপদ হতে পারে। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় জল কমিশনের চেয়ারম্যান অশ্বিন পাণ্ড্য আলোচনাচক্রে বলেন, গত ক’বছরে অল্প সময়ে অতিবৃষ্টি হচ্ছে। অনেক সময়ে বন্যা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কাজের কাজ, অর্থাৎ জলস্তর পূরণ হচ্ছে না। কারণ অল্প সময়ে অতিবৃষ্টির বাড়তি জলস্রোত ভূগর্ভে সঞ্চিত না-হয়ে নদী-নালা, খাল-বিল দিয়ে বয়ে যাচ্ছে সমুদ্রে। গৌরাঙ্গচরণবাবু অবশ্য মনে করেন, পশ্চিমবঙ্গের মাটির যা চরিত্র, তাতে অতিবৃষ্টিতেও কিছুটা জলস্তর পূরণ হয়। পুরো জলটা জলে যায় না।
তবে পশ্চিমবঙ্গে ভূগর্ভস্থ জলস্তর যে ভাবে নামছে, রাজ্যের আর্সেনিক টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান কমলজ্যোতি নাথ তাতে যারপরনাই চিন্তিত। তিনি চাইছেন, সামগ্রিক ভাবে ভূগর্ভস্থ জল ব্যবহারে অবিলম্বে বিধি-নিষেধ বলবৎ হোক। কমলজ্যোতিবাবুর দাবি, এ রাজ্যের আটটি জেলা ইতিমধ্যে আর্সেনিক দূষণের কবলে। খাস কলকাতার একাংশও রেহাই পায়নি। সাতটি জেলায় ফ্লুওরাইড দূষণ। ভূগর্ভস্থ জলস্তরে ভারী ধাতুরও সন্ধান মিলছে, যা যথেষ্ট ভয়ের কারণ। তাঁর মতে, অনেক ক্ষেত্রে এ জন্য অপরিশোধিত শিল্প-বর্জ্যের বড় ভূমিকা আছে।
এবং আর্সেনিক দূষণের প্রসঙ্গেই ভূগর্ভস্থ জল দিয়ে সেচকার্যের বাড়বাড়ন্তে অশনি সঙ্কেত দেখছেন কল্যাণবাবু। কেন?
নদী-বিশেষজ্ঞের যুক্তি, আর্সেনিক-প্রবণ এলাকায় মাটির তলার জলে আর্সেনিক থাকে। সেই জল নির্বিচারে তুলে চাষের জমিতে দেওয়ায় মাটির উপরের স্তরে আর্সেনিক ছড়িয়ে পড়ছে। অথচ জল থেকে আর্সেনিক মুক্ত করার প্রযুক্তি থাকলেও মাটির আর্সেনিক দূর করার প্রযুক্তি এখনও জানা নেই। কাজেই জমিতে মেশা আর্সেনিকের বিষ ধান, সব্জি-সহ খাদ্য-শৃঙ্খলে ঢুকে পড়ছে। “খাদ্য-শৃঙ্খলে আর্সেনিক ঢুকে পড়লে সমাজের বড় অংশে তা ছড়িয়ে পড়বে।” আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন কল্যাণবাবু।
এমন পরিস্থিতিতে রাজ্য সরকার সেচ-নলকূপে রাশ তুলে নিল কেন?
রাজ্যের জলসম্পদমন্ত্রী সৌমেন মহাপাত্রের আশ্বাস, জলস্তর সম্পর্কে আশঙ্কার কোনও কারণ নেই। তাঁর দাবি, এ বছরের পর্যাপ্ত বর্ষা ও সরকারের ‘জল ধরো, জল ভরো’ প্রকল্প রূপায়ণের ফলে ভূগর্ভস্থ জলস্তরের ঘাটতি পূরণ হয়ে গিয়েছে। রাজ্যের সেচমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য মেনে নিয়েছেন যে, কিছুটা জল-সঙ্কট তৈরি হচ্ছে। রাজীববাবুর বক্তব্য, “শিল্প-নগরায়ণের বিকাশ জলের ব্যবহার বাড়াচ্ছে। ব্যাপারটা রাজ্য সরকারের মাথায় আছে।”
বর্ষার জল ধরে রেখে সেচের কাজে লাগানোর বেশ কিছু পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে বলে জানান সেচমন্ত্রী। |