ভোরের আলো ফোটার আগেই বুলডোজার নিয়ে প্রস্তাবিত উত্তরপাড়া ফিল্মসিটির জন্য নির্দিষ্ট ‘বেদখল’ জমির দখল নিল প্রশাসন। বৃহস্পতিবার ভোরে এই ঘটনায় তখন অশান্তি না বাধলেও পরে এ নিয়ে আদালতে যান ওই জমিতে থাকা ইটভাটার মালিকেরা। তাঁদের আবেদনের ভিত্তিতে আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত সেখানকার কাজে স্থগিতাদেশ দিয়েছে কলকাতা হাইকোর্ট। রাজ্য প্রশাসনের দাবি, ইটভাটার মালিকদের নোটিস দেওয়া হয়েছিল আগেই। তাঁরা উঠতে রাজি না হওয়াতেই কড়া পদক্ষেপ করতে হয়েছে।
উত্তরপাড়া পুর-এলাকায় গঙ্গা এবং জিটি রোডের মাঝে কলকাতা পুরসভার ৪০০ বিঘা জমি রয়েছে। রাজ্যে ক্ষমতায় এসেই মূলত মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্দেশে ওই জমিতে একটি ফিল্ম সিটি গড়ার তোড়জোড় শুরু হয়। শুধু ফিল্মসিটি নয়, সেখানে একটি ফাঁড়ি এবং দমকল কেন্দ্র গড়ারও পরিকল্পনা রয়েছে রাজ্যের। কয়েক দশক ধরে গঙ্গা লাগোয়া কলকাতা পুরসভার ওই জমিতে ১৪টি ইটভাটা রয়েছে। প্রশাসনের তরফে মেয়র-সহ প্রশাসনিক কর্তারা বারংবারই সেখানে জমি দেখতে যান। টলিউডের অভিনেতা-পরিচালকেরাও জমিটি সরেজমিন দেখে গিয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে তাঁদের পছন্দের কথা জানিয়েছিলেন। |
প্রস্তাবিত ফিল্ম সিটির জমিতে ভেঙে দেওয়া হচ্ছে ইটভাটা। বৃহস্পতিবার, উত্তরপাড়ায়। —নিজস্ব চিত্র। |
এর পরেই বিষয়টি নিয়ে সরকারি স্তরে নাড়াচাড়া শুরু হয়। ভাটা মালিকদের সঙ্গে জেলা প্রশাসন ও কলকাতায় পুর-কর্তৃপক্ষ বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে ইটভাটার অধিকাংশ মালিকই প্রাথমিক ভাবে ক্ষতিপূরণের শর্তে সরকারকে ওই জমি ছেড়ে দেওয়ার কথা জানান। তিনটি ইটভাটার মালিক প্রশাসনিক বৈঠকেই দাবি করেন, ওই জমি তাঁদের, পুরসভার নয়। যদিও অন্যরা জমি কলকাতা পুরসভার বলে মেনে নেন। জমি ঘিরে এই বিতর্কেই নয়া মোড় এল বৃহস্পতিবার ভোরের ঘটনায়।
এ দিন ইটভাটা মালিকদের আবেদন মেনে কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী মঙ্গলবার পর্যন্ত ওই জমিতে ভাঙার কাজ বন্ধ রাখার নির্দেশ দেন। ইটভাটার মালিকদের পক্ষে আইনজীবী অশোক চক্রবর্তী বলেন, “ওই জমি সরকারের নয়। তাই সরকার ওই জমিতে কোনও সংস্থাকে ফিল্মসিটি করার অনুমোদন দিতে পারে না। যথাযথ ভাবে জমি অধিগ্রহণ না করে আগেই ইটভাটা ভাঙা যাবে না।” আগামী মঙ্গলবার বিচারপতি এ নিয়ে চূড়ান্ত রায় দেবেন।
এ দিন কলকাতা পুরসভার মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায় বলেন, “শহরের মধ্যে আমরা এ ভাবে ইটভাটা রাখব না। মালিকদের সঙ্গে কথাবার্তা চলছে। বিকল্প হিসেবে ক্ষতিপূরণের বিষয়টি সরকার গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছে।” তবে তিনি সরাসরি জানান, ওইসব ইট ভাটার শ্রমিকদের সরকারি স্তরে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার জায়গা নেই। মেয়র বলেন, “ওঁরা সবাই অস্থায়ী শ্রমিক।” যদিও প্রস্তাবিত উত্তরপাড়া ফিল্মসিটির জমিতে থাকা ইটভাটার শ্রমিকদের নানা দাবিকে সামনে রেখে সিটু আন্দোলনের হুমকি দিয়েছে।
এর আগে যে সব ভাটা মালিক জমি তাঁদের বলে দাবি করেন, তার সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন কলকাতার পুর-কমিশনার খলিল আহমেদ। তাঁদের শুনানিও হয় উত্তরপাড়া পুরসভায়। এর পরে অবশ্য অধিকাংশ ভাটা-মালিকই অবস্থান বদলে আদালতে যান। ওই এলাকায় দীর্ঘদিন ধরেই ইটভাটা চালাচ্ছেন বাবলু দাশগুপ্ত। তিনি বলেন, “আমরা চাইছি, রাজ্য সরকার সংবিধান এবং আইন মেনেই কাজ করুক। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু আজ প্রশাসন একতরফা ভাবে যা করল, তা মোটেই কাম্য ছিল না।” অন্য একটি ইটভাটার মালিক অশোক ঘোষ বলেন, “সরকারি স্তরে কথাবার্তা চলছিল। কিন্তু সরকার কথা রাখল না। দিদি বারবার বলছেন, শিল্প তুলে দিয়ে শিল্প নয়। আমাদের সমস্ত কাগজপত্র আছে। সরকারি নোটিস দেওয়া হল না। আমরা রয়্যালটি দিই। আদালতে গিয়েছি। তার মধ্যেই সব ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হল।”
যদিও শ্রীরামপুরের মহকুমাশাসক জয়সি দাশগুপ্ত ইটভাটা মালিকদের সমস্ত কথা নস্যাৎ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “এখানে কোটি-কোটি টাকার ব্যবসা হচ্ছে। সরকারকে ওঁরা এক টাকাও রয়্যালটি দেন না। গত তিন মাস ধরে বারবার অনুরোধ করা হচ্ছে। ওঁরা শোনেননি।” হুগলির জেলাশাসক মনমিত নন্দা বলেন, “সরকারি নির্দেশ ছিল। সেই মাফিকই প্রশাসন, কলকাতা পুরসভা, পুলিশ, ভূমি ও ভূমি রাজস্ব দফতর একসঙ্গে কাজ শুরু করেছে।”
এ দিন অন্ধকার থাকতেই মহকুমাশাসক, উত্তরপাড়া থানার আইসি অরিজিৎ দাশগুপ্তকে সঙ্গে নিয়ে আসরে নামেন। অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির আশঙ্কায় প্রচুর পুলিশ মোতায়েন রাখা হয় কোন্নগর ফাঁড়িতে। আনা হয় বুলডোজার, ব্রেক ভ্যান, কলকাতা পুরসভার গাড়ি। কার্যত বিনা প্রতিরোধে ইটভাটার যন্ত্রাংশ পুরসভার গাড়িতে চাপিয়ে কোন্নগর ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। কোতরংয়ের ওই ইটভাটাগুলিতে কানাইপুরের বাসিন্দা সুদেব ঘোষ পাম্পসেট এবং অন্য যন্ত্রাংশ ভাড়া দেন। তিনি বলেন, “দীর্ঘদিন ধরেই এই সব ইটভাটায় ভাড়ায় যন্ত্রাংশ দিই। পুলিশকে অনুরোধ করেছি। ওঁরা বলেছেন মালপত্র ছেড়ে দেবেন।”
এ দিনের অভিযানে বেজায় ফাঁপরে পড়েছেন বিহার, ঝাড়খন্ড এবং এ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গা থেকে কাজে আসা ভাটার গরিব শ্রমিকরা। ছেলেমেয়ে নিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে সব কিছু দেখেছেন তাঁরা। বিহারের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা পিঙ্কু তাঁতি, রঞ্জিত তাঁতিরা বলেন, “ইট তৈরি করি। খেটে খাই। সরকার আমাদের পেটে লাথি মারল। ইটভাটার মালিকরা আমাদের জন্য কিছু করবে না। আমরা তো ঠিকাদারের লোক। ঠিকাদার যখন বিহার থেকে আরও লোক আনতে গিয়েছেন, তখনই সব ভেঙে দেওয়া হল।” বৃদ্ধা যমুনা প্রামাণিক, মমতা মণ্ডলরা আবেদন করেন, “সরকার আমাদের জন্য বিকল্প কিছু ভাবুক।” ইটভাটার গাড়িচালক নেপাল মণ্ডল, রবি মণ্ডলরা বলেন, “মাথা গোঁজার জায়গাটুকু সরকার দিন। বাকিটা খেটে খাব।” স্থানীয় ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতা দিলীপ মুখোপাধ্যায় বলেন, “আমরা প্রায় ২৫ জন ব্যবসায়ী আছি। সকলেরই ছোট ছোট দোকান। সরকার আমাদের বিকল্প জায়গা দিক।”
সরকারের দিকে আঙুল তুলেছেন সিটু নিয়ন্ত্রিত ইটভাটা শ্রমিক সংগঠনের নেতা শ্যামল মিত্রও। তিনি বলেন, “মা-মাটি-মানুষের সরকার জোর করে মানুষের রুটিরুজি বন্ধ করে দিল। এই অত্যাচার বন্ধ না করলে আমরা বৃহত্তর আন্দোলনে যাব।”
জেলা তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি ও পুরসভার চেয়ারম্যান ইন কাউন্সিল দিলীপ যাদব অবশ্য বলেন,“এটা একেবারেই প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। গত কয়েক মাস ধরে বারবারই ইটভাটার মালিকদের সঙ্গে সরকারি স্তরে বৈঠক হয়েছে। জমিটি কলকাতা পুরসভার, তা বৈঠকে ইটভাটার অধিকাংশ মালিক মেনে নিয়েও আদালতে গেলেন। এটা একেবারেই কাম্য ছিল না। পরিস্থিতি ওঁরা যে দিকে নিয়ে গেলেন, তাতে জমি পেতে প্রশাসনিক স্তরে কঠোর হওয়া ছাড়া অন্য বিকল্প ছিল না।”
|