মাউসের এক ক্লিকেই এক প্রান্তের তথ্য মুহূর্তে বিশ্বের অন্য প্রান্তে পৌঁছে যাচ্ছে। কিন্তু বান্দোয়ানে লেখা চিঠি পুরুলিয়ায় পৌঁছতে পেরিয়ে যাচ্ছে তিন দিন। আর ডাক বিভাগের এই শম্বুক গতির খেসারত দিচ্ছেন সাধারণ মানুষ। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জেলার অন্যত্র ডাক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটলেও বান্দোয়ানের অবস্থার পরিবর্তন ঘটেনি।
ই-মেল, চ্যাটিং, ফেসবুক অথবা ট্যুইটারের যুগে আদি ডাক ব্যবস্থা নিয়ে ক’জনই বা মাথা ঘামান? তবু এখনও সরকারি চিঠিপত্র, চাকরির ইন্টারভিউয়ের চিঠি প্রভৃতির জন্য ডাক যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করতেই হয়। ঝাড়খণ্ড ঘেঁষা বান্দোয়ানের বেশ কিছু এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক মেলে না। এই এলাকায় পাহাড় জঙ্গলের জন্য নেটওয়ার্কের সমস্যা বলে দাবি মোবাইল সংস্থাগুলির। তাই এখনও এই এলাকার বাসিন্দারা আত্মীয়দের খবরাখবরের জন্যও চিঠিপত্রের ওপরে অনেকাংশে নির্ভরশীল। |
বান্দোয়ানের রাজগ্রামের বাসিন্দা অসিত টুডুর অভিজ্ঞতা, “জীবনে একবারই চাকরির পরীক্ষায় বসার সুযোগ এসেছিল। ২০০১ সালে পুরুলিয়া জেলাশাসকের অফিস থেকে চাকরির ইন্টারভিউয়ের চিঠি পাঠানো হয়েছিল। খাম খুলে দেখি আগের দিনই পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে। সময়ে চিঠিটা পেলে হয়তো আমার জীবনটা পাল্টে যেত।” এখন তিনি কাঠ কেনাবেচা করে সংসার চালান। গুরুড় গ্রামের বসন্ত মাহাতো বলেন, “আদালতের একটা চিঠি দু’দিন দেরিতে আসায় পরে অনেক আইনি জটিলতার মধ্যে পড়তে হয়েছিল।
রাজ্যের অন্যত্রও চিঠিবিলি নিয়ে এমন অভিযোগ শোনা গেলেও এখানকার ডাক বিলির ছবিটা একটু ভিন্ন। ডাক বিভাগের কর্মীরাই জানিয়েছেন, সোমবার বেলা ১২টা নাগাদ পুরুলিয়ার জন্য বান্দোয়ানে চিঠি ফেললে সে দিন ওই চিঠির গতি হবে না। কারণ বেলা ১১টায় যাবতীয় চিঠি ব্যাগে ভরে সাইকেলে রওনা হয়ে যান ডাককর্মী। ওই চিঠি পরের দিন মঙ্গলবার ডাকবাক্স থেকে বের হবে। বান্দোয়ানের পোস্টমাস্টার চিত্তরঞ্জন মহাপাত্র বলেন, “এখান থেকে ডাক নিয়ে পূর্ণচন্দ্র কর্মকার ১২ কিলোমিটার দূরে সাইকেলে ঝাড়খণ্ডের বাঙ্গুড়দা গ্রাম পর্যন্ত যান। সেখানে বরাবাজারের ডাককর্মী জাগরণ মাহাতো আসেন ওদিককার চিঠি নিয়ে। দু’জনে পরস্পরের চিঠি বিনিময় করেন।”
বান্দোয়ানের চিঠি বরাবাজারের ডাকঘরে পৌঁছতে সে দিন বিকেল গড়িয়ে যায়। বরাবাজারের পোস্টমাস্টার বাবুলাল হেমব্রম জানান, বুধবার সকালে চিঠি নিয়ে ডাককর্মী বলরামপুরের দিকে যান। দু’টি ব্লকের মাঝামাঝি জায়গা ভবানীপুরে বলরামপুরের ডাককর্মীর সঙ্গে চিঠি বিনিময় করা হয়। বলরামপুরের রাঙাডি ডাকঘরে ওই চিঠি পোঁছতে দুপুর ৩টে বেজে যায়। বলরামপুরের পোস্টমাস্টার অমর মিত্রের কথায়, “বান্দোয়ান, বরাবাজার ও বলরামপুরের ডাক প্রতিদিন বিকেল ৪টে নাগাদ বিশেষ গাড়িতে পুরুলিয়ায় পাঠানো হয়।” পরের দিন অথাৎ বৃহস্পতিবার ওই চিঠি পুরুলিয়া শহরে বিলি হওয়ার কথা।
ডাককর্মীরা জানাচ্ছেন, বান্দোয়ান ও বরাবাজারের থেকে সরাসরি পুরুলিয়ায় ডাক পৌঁছানোর ব্যবস্থা চালু করার দাবি জানানো সত্ত্বেও কোনও পরিবর্তন হয়নি। ফলে শতাব্দীকাল ধরে শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষায় এ ভাবেই ডাক বিলি করা হয়ে আসছে। কিন্তু তিন দিনের এই শৃঙ্খলাও অনেক সময় ব্যাহত হয়। রাস্তায় ডাককর্মীদের দুষ্কৃতীদের খপ্পরে পড়ার নজির না থাকলেও দীর্ঘ রাস্তায় ডাককর্মীদের সাইকেল বিগড়ে যাওয়ায় ডাক পৌঁছানোর দেরি হওয়ার অনেক ঘটনা ঘটেছে। ফলে চিঠি পৌঁছতে আরও বিলম্ব হয়েছে।
বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, সড়ক পথে ভায়া বরাবাজার হয়ে পুরুলিয়া ও বান্দোয়ানের মধ্যে দূরত্ব ৬৫ কিলোমিটার। বাসে ওই পথ যেতে সময় লাগে ঘণ্টা চারেক। তাহলে এখনও চিঠি কেন সেই মান্ধাতার আমলে আটকে রয়েছে? সদুত্তর মেলেনি জেলা ডাকবিভাগের কর্তাদের কাছ থেকে। পুরুলিয়া জেলা মুখ্য ডাকঘরের পোস্টাল সুপারিন্টেন্ডেন্ট তপন চক্রবর্তীর আশ্বাস, প্রাচীন এই ব্যবস্থা তুলে ডাক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানো হবে। তিনি বলেন, “বান্দোয়ানে সাইকেলের মাধ্যমে ডাক বহনের যে ব্যবস্থা রয়েছে তার আধুনীকিকরণ করা হবে। সে জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।” |