নোনা হাওয়ায় ফিকে হয়ে গিয়েছে কটেজের পালিশের রং। বাংলো চত্বরে কেয়ারি করা বাগানেও অযত্নের ছাপ স্পষ্ট। দক্ষিণ ২৪ পরগনার সাগরে রাজ্য সরকারের উদ্যোগে সাড়ে চার কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি সেগুন কাঠ ও বেলজিয়ান কাচের কটেজের এখন এমনই হাল।
গত বছর গঙ্গাসাগর মেলার আগে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় সাগর থেকে প্রায় ৬০ ফুট দূরে অনধিক দেড় বিঘা জমির উপর তৈরি হয় আগাগোড়া সেগুন কাঠের ওই কটেজ। যার ভিতরে রয়েছে বেলজিয়ান কাচের কারুকাজ। তৈরি হয় কটেজ লাগোয়া ওয়াচ টাওয়ার। কটেজের চারিদিকে বাতিস্তম্ভে লাগানো হয় হ্যালোজেন লাইট। কটেজের চারপাশে সবুজের ছোঁয়া আনতে পোঁতা হয়েছিল লক্ষাধিক টাকার বিদেশি ঘাস। কটেজে দু’টি ঘর। দু’টিই শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। পুরো এলাকা ঘেরা শাল কাঠের খুঁটির প্রাচীরে। কিন্তু এক বছর পর কয়েক কোটি টাকার ওই কটেজের চেহারায় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবের ছাপ স্পষ্ট। বহু জায়গাতেই চটে গিয়েছে পালিশ। ওয়াচ টাওয়ারের ছাদে বাসা বেঁধেছে চড়ুই। কটেজের চারিদিকের সবুজ ঘাসে হলদেটে রং ধরেছে। শুধু পালিশ নয়, সেগুন কাঠের দেওয়ালের গায়েও চিড় ধরেছে। শাল কাঠের খুঁটির দরজায় সব সময়ই তালা ঝোলে। সন্ধের পর অবশ্য নিয়ম করে হ্যালোজেন জ্বলে। |
শীতের দুপুরে শাল কাঠের খুঁটির দরজায় তালা ধরে একাধিক বার নাড়া দিলেও কোনও সাড়া মিলল না। বেড়া ধরে কিছুটা এগিয়ে যেতেই কটেজ চত্বরে চোখে পড়ল একটি মাটির কুঁড়ে ঘর। দেওয়ালে রঙ দিয়ে শিল্প করা। কঞ্চির জানলায় শুকোচ্ছে ভিজে গামছা। বোঝা গেল বাড়িতে কেউ রয়েছেন। ‘কেউ আছেন’, বেশ কয়েক বার চিৎকার করার পর বেরিয়ে এলেন একজন। পরনে লুঙ্গি। খালি গা। পরিচয় জানতে চাইলে, বুকে হাত বুলিয়ে জানালেন, “বাড়ি দেখাশোনা করি।” ‘গেটটা একটু খুলুন না। ঘুরে দেখি’, বলতেই সপাট উত্তর, “অনুমতি নেই।” “আচ্ছা, তা হলে কোথায় অনুমতি পাওয়া যাবে?” “বলতে পারব না।” “আচ্ছা, এই বাড়িতে কি কেউ আসে না?” “সাধারণত না। তবে কয়েক দিন আগে সাগর থানার বড়বাবু এসে ঘুরে দেখে গিয়েছেন। গত বছর মেলার সময় শুনেছিলাম ‘দিদি’ (মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) আসবেন। তো উনি এলেন না। শুনছি হেলিপ্যাড হবে। তখন হয়তো আসবেন।”
গত বছর থেকেই সাগর এলাকায় পর্যটনের উপর জোর দিয়েছে রাজ্য সরকার। যার অঙ্গ হিসাবে কপিলমুনির আশ্রম থেকে কিছু দূরে কয়েকটি কটেজও তৈরি করা হচ্ছে। কিন্তু সেগুন কাঠ আর বেলজিয়ান কাচের এই কটেজ রীতিমত রহস্য তৈরি করেছে সাগরবাসীর কাছে। কয়েক কোটি টাকার এই কটেজ না কোনও অতিথি নিবাস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে, না কোনও প্রশাসনিক কাজে। যদিও মাঝেমধ্যে প্রশাসনের লোকেদের আনাগোনা রয়েছে বলে জানালেন স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা। সাগরতটের একেবারে কাছে এমন কটেজ তৈরি নিয়ে পরিবেশবিদদের একাংশের ব্যাখ্যা, সাগরের নোনা হাওয়ায় সেগুন কাঠের ওই বাড়ির ক্ষতি হওয়াটাই স্বাভাবিক। দু’মাস অন্তর পালিশ করলেও তা টিকবে না। তা ছাড়া এ ধরনের বাড়ির রক্ষণাবেক্ষণও বেশ ব্যয়বহুল। তা ছাড়া সাগরের যে অংশে বাড়িটি তৈরি হয়েছে তাতে কোনও বড় ঝড়-ঝঞ্ঝা তো দূর, একটা ষাড়াষাড়ি বান এলেই তা মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়বে।
সাগরে পর্যটনের প্রসার জোরদার করতে গঙ্গাসাগর-বকখালি ডেভলেপমেন্ট অথরিটি গঠন করেছে রাজ্য সরকার। যার চেয়ারম্যান সাগরের তৃণমূল বিধায়ক বঙ্কিম হাজরা। কটেজের বিষয়ে তাঁর বক্তব্য, “হিডকো ওই কটেজটি গঙ্গাসাগর-বকখালি ডেভলেপমেন্ট অথরিটিকে হস্তান্তর করেছে।” তবে কটেজটি কী ভাবে ব্যবহার হবে তা সঠিক ভাবে জানাতে পারেননি বিধায়ক। তিনি বলেন, “হয়তো কোনও ভিভিআইপি থাকবেন।”
যদিও এই ভিভিআইপির ব্যাপারে খোলসা করে তিনি কিছু বলতে চাননি। তাঁর কথায়, “আমি এই বিষয়ে কিছুই বলতে পারব না।” তবে সাগরে গুঞ্জন, রাজ্যে তো এখন ভিভিআইপি মানে তো ‘দিদি’ই। |