আর্থিক লোকসানে ধুঁকতে থাকা উত্তরবঙ্গ রাষ্ট্রীয় পরিবহণ নিগমের (এনবিএসটিসি) হাল ফেরাতে এ বার তথ্য-প্রযুক্তির হাত ধরতে চান কর্তৃপক্ষ। বাসের টিকিট বিক্রির উপর কড়া নজর রাখতে চালু হবে ‘ই-টিকিটিং’ ব্যবস্থা। একই সঙ্গে চালু করার চেষ্টা হচ্ছে বিমান ও ট্রেনের মত ওয়েবসাইট থেকে আগাম অনলাইন টিকিট বুকিং ব্যবস্থাও। দু’টি ব্যবস্থাই চালুর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রাজ্য সরকারের অধীনস্থ একটি তথ্য-প্রযুক্তি সংস্থাকে। নিগম সূত্রের খবর, আগামী নতুন বছরের গোড়াতেই প্রথম পর্যায়ের ই-টিকিটিং পদ্ধতি চালু করার তোড়জোড় শুরু হয়েছে।
এনবিএসটিসি-র চেয়ারম্যান উত্তরবঙ্গ উন্নয়নমন্ত্রী গৌতম দেব বলেন, “এনবিএসটিসিকে ঘুরে দাঁড় করাতে আমরা নানা পরিকল্পনা নিয়েছি। সংস্থার আর্থিক সংস্থান বাড়াতে বাস বাড়ানো, বন্ধ রুটে বাস চালানো ছাড়াও এ বার ই-টিকিটিং এবং অনলাইন বুকিং ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে। আশা করছি, শীঘ্রই এই ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হবে। এতে টিকিট নিয়ে কন্ডাক্টরদের বিরুদ্ধে নানা সময়ে ওঠা অভিযোগ বন্ধ হবে।” পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র বলেন, “উত্তরবঙ্গে পর্যটনের বিষয়টি জড়িত থাকায় ওখানে আগে ই-টিকিট চালু করা হচ্ছে। ধাপে ধাপে অন্যত্রও তা করা হবে।”
১৯৪৫ সালের ১ এপ্রিল শুরু হওয়া এনবিএসটিসি দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে কাগজে ছাপানো টিকিট বিক্রি করে আসছে। এনবিএসটিসি’র বাসে উঠে টিকিট কাটলে ছোট চিরকুটের মত টাকার অঙ্ক ছাপানো টিকিট যাত্রীদের দেওয়া হয়। আর বাস টার্মিনাস-সহ বিভিন্ন কাউন্টার থেকে টিকিট কাটলে কম্পিউটার প্রিন্ট করা টিকিট দেওয়া হয়ে থাকে। যে কোনও বাসের যাত্রাপথে একাধিকবার সংস্থার ‘চেকিং স্টাফ’ বাসে উঠে যাত্রী সংখ্যা, টাকার হিসাব এবং টিকিটের হিসেব মিলিয়ে দেখেন। সংস্থার কিছু অফিসার জানান, চেকিং স্টাফদের জন্য একাংশ অসাধু কর্মীদের বাড়বাড়ন্ত অনেকটাই বন্ধ হয়েছে। কিন্তু তা পুরোপুরি বন্ধ করা যায়নি বলে অভিযোগ। ওই অফিসারেরা জানান, অনেক সময়ই যাত্রীদের টাকা ফেরত না দিয়ে টিকিটের পিছনে ‘বকেয়া’ লিখে দেওয়া হয়। পরে ওই যাত্রী গন্তব্যে নেমে যাওয়ার আগে তাঁকে টাকা ফেরত দিয়ে টিকিটটা নিয়ে নেওয়া হয়। পরে তা ফের অন্য যাত্রীকে দিয়ে টাকা আদায় করা হয় বলে অভিযোগ।
নয়া ব্যবস্থায় ই-টিকিটিং মেশিনটি কন্ডাক্টরদের কাঁধে থাকবে। সেখানে নির্দিষ্ট টাকার অঙ্ক এবং রুট দিয়ে ‘এন্টার’ করলেই ছোট্ট মেশিনটি থেকে স্লিপ বার হবে। যা শুধুমাত্র একজনকেই দেওয়া যাবে। তাতে সময়ও লেখা থাকবে। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে বাসের সবাইকে টিকিট দেওয়া হচ্ছে কি না তা চেকিং স্টাফরা বাসে উঠে পরীক্ষা করে নেবেন। এতে সময়ও কম লাগবে। বাসটি গন্তব্যে পৌঁছালেই সঙ্গে সঙ্গে মেশিনটি থেকে টাকার অঙ্ক, টিকিটের সংখ্যা পরীক্ষা করে চেকিং স্টাফদের দেওয়া তথ্যের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া হবে। একাধিক রাজ্যে এমন ই-টিকিটিং ব্যবস্থা আগে থেকেই চালু রয়েছে। এ বার চালু হচ্ছে উত্তরবঙ্গেও।
সংস্থার আয় বাড়াতে অনলাইনেও টিকিট বুক করার সুযোগ দেওয়া হবে। বস্তুত, যাত্রীদের একটা বড় অংশের অভিযোগ, বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার পরিচালিত বাসে ইন্টারনেটের মাধ্যমে টিকিট কাটার সুযোগ থাকলেও সরকারি পরিবহণ সংস্থায় সেই সুযোগ মেলে না। তাই সরকারি বাস ডিপোতে গিয়ে লাইন দিয়ে টিকিট কাটার হয়রানি নিতে চান না অনেকেই। তাঁরা বেছে নেন বেসরকারি পরিবহণ সংস্থাগুলিকেই। এই ব্যবস্থা চালু হলে সেই সব যাত্রীরা ফিরে আসতে পারেন। আবার, যেহেতু উত্তরবঙ্গে বহু পর্যটক আসেন তাই এই ব্যবস্থায় পর্যটকদেরও সুবিধা হতে পারে। নিগমের কর্তারা জানান, ট্রেনের উপর অত্যধিক চাপ থাকায় অনেকেই সময়ে টিকিট পান না। বাসে অনলাইনে আসন সংরক্ষণ করতে পারলে তাঁরা সেই সুবিধা নেবেন নিগম কর্তাদের আশা। এতে সংস্থার আয়ও বাড়বে। গৌতমবাবুর কথায়, “এখন সবার হাতেই সময় কম। যে কোনও টিকিটই লাইনে দাঁড়িয়ে কাটার বিষয়টাই কমে যাচ্ছে। এটা মাথায় রেখেই অনলাইন বুকিং শুরু হচ্ছে।”
নিগম সূত্রের খবর, সংস্থার হাতে বর্তমানে ৭০০ বাস থাকলেও রাস্তায় চলাচলের যোগ্য ৬৭০টি। এর মধ্যে যান্ত্রিক ত্রুটি, কর্মী সমস্যা, বন্ধ রুট মিলিয়ে ৫৫০ মত এনবিএসটিসি-র বাস রোজ রাস্তায় চলাচল করছে। প্রতিমাসে ৬ কোটি থেকে সাড়ে ৬ কোটি টাকা টিকিট বিক্রির মাধ্যমে আয় হয়। নতুন এই দু’টি পদ্ধতি চালু করা গেলে, এই টাকার অঙ্ক ৭ কোটির কাছাকাছি যাবেই বলে সংস্থার একাংশ অফিসার জানান। বর্তমানে রাজ্য সরকার প্রতি মাসে ৬ কোটি ১০ লক্ষ টাকার মত নিগমকে অনুদান দিচ্ছে রাজ্য সরকার। আর বেতন-সহ সমস্ত খরচ বাবদ-সহ নিগমের প্রতি মাসে খরচ প্রায় ১৪ কোটি টাকা। গৌতমবাবু জানান, নতুন দু’টি ব্যবস্থা চালু হলে টিকিট বিক্রি অনেকটা বাড়বে বলেই তাঁরা আশা করছেন।
এ ছাড়াও বাসের সঠিক অবস্থান জানতে জিপিএস (গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম) ব্যবহার করারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। নিগম সূত্রের খবর, কিছুদিনের মধ্যেই সংস্থার হাতে আসতে চলছে জহরলাল নেহরু ন্যাশনাল আর্বান রিনিউয়াল মিশনের ১০০টি নতুন বাস। ওই বাসগুলিতে জিপিএস থাকবে বলে ঠিক হয়েছে। এতে বাসটি কোথায় রয়েছে, কতক্ষণে আগামী গন্তব্যে পৌঁছাবে তা খুঁটিনাটি জানা যাবে। গৌতমবাবু বলেন, “একটি কন্ট্রোল রুম চালু হবে। সেখান থেকেই এই সমস্ত বিষয় নিয়ন্ত্রণ করা হবে।” |