গরম জামা তো দূরের কথা, পরনের জামাকাপড়টুকুও নেই। যাঁদের সেটুকু রয়েছে, তাঁদেরও কনকনে শীতে মেঝেতে পাতার জন্য তোষক নেই। চিকিৎসক নেই। নেই পানীয় জলের ব্যবস্থাটুকুও। মুর্শিদাবাদ জেলার কান্দি ব্লকের মহালন্দি এলাকার গৃহহীন মনোরোগীদের হোম (‘হোম ফর লুনাটিক ভ্যাগর্যান্টস’) পরিদর্শন করতে গিয়ে এমনই মর্মান্তিক অবস্থা প্রত্যক্ষ করলেন রেল প্রতিমন্ত্রী অধীর চৌধুরী।
আজ, মঙ্গলবার, দুপুরে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুর্শিদাবাদের রেজিনগরে জেলার উন্নয়ন নিয়ে প্রশাসনিক বৈঠক করবেন। তার ২৪ ঘণ্টা আগে মুর্শিদাবাদ জেলাপরিষদের সভাধিপতি শিলাদিত্য হালদারকে সঙ্গে নিয়ে অধীরবাবু মহালন্দির হোমে গেলেন। কেন মুখ্যমন্ত্রীর সফরের ঠিক আগেই তাঁর এই উদ্যোগ? অধীর চৌধুরি বলেন, “হোমের চূড়ান্ত অব্যবস্থার কথা আমার কানে এসেছে গত শনিবার। স্থানীয় সাংসদ হিসেবে নিজের চোখে দেখতে এসেছি।” আবাসিকদের ভাঙাচোরা, নোংরা খাবার থালা দেখিয়ে তিনি বলেন, “ওই থালা দেখেই সোনার বাংলার চেহারাটা বোঝা যাচ্ছে।”
মুখ্যমন্ত্রীর সফরের ঠিক আগে অধীরবাবুর সোমবারের হোম পরিদর্শন রাজনৈতিক তরজার আবহ তৈরি করলেও, আবাসিকদের দশা দেখে তাঁর ক্ষোভ ও উদ্বেগ স্পষ্ট হয়েছে বারবার। তিনি জানান, অপুষ্টি ও বিনা চিকিৎসায় গত বছর ওই হোমের ৩০ জন মারা দিয়েছে, এ বছর ২৬ জন আবাসিকের মৃত্যু হয়েছে। তাঁর আশঙ্কা, “অপুষ্টির কারণে আবাসিকদের অবস্থা করুণ। দিন কয়েকের মধ্যে আরও চার-পাঁচ জন মারা যেতে পারে।” হোম কর্তৃপক্ষের অবশ্য দাবি, এ বছর এখনও পর্যন্ত ১২ জন মারা গিয়েছেন।
জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, ওই হোমে নারী-পুরুষ মিলিয়ে ২১২ জন আবাসিক। বরাদ্দ ৫০ জন কর্মীর মধ্যে রয়েছেন মাত্র ২৬ জন। চিকিৎসক নেই। জরুরি প্রয়োজনে স্থানীয় এক হাতুড়েকে ডাকা হয়। চালক থাকলেও অ্যাম্বুল্যান্সটি কয়েক বছর ধরে অচল। ওষুধ, খাদ্য ও পোশাকের জন্য আবাসিক পিছু মাসিক বরাদ্দ মাত্র ১২৫০ টাকা। বহু আবাসিকের গায়ে পোষাক নেই কেন, প্রশ্ন করলে ওই হোমের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক আকবর আলি খান বলেন, “ছিল। কিন্তু মানসিক ভারসাম্যহীন হওয়ায় অনেকেই ছিঁড়ে ফেলেছে।”
আকবর আলি খান বছর খানেক ধরে রাজ্য সমাজ কল্যাণ দফতরের ওই হোমের ম্যানেজারের দায়িত্বে রয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি বড়ঞা এবং কান্দি, এই দু’টি ব্লকের চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট অফিসারের দায়িত্বও সামলাচ্ছেন। সপ্তাহে দু’দিনের বেশি মহালন্দির হোমে তিনি যেতে পারেন না, স্বীকার করে বলেন, “তাতে যা হওয়ার, তাই হচ্ছে।”
সমাজ কল্যাণ দফতররে মুর্শিদাবাদ জেলা আধিকারিক বদরুদ্দোজা বলেন, “প্রতিকার চেয়ে ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষকে বহুবার বলা হয়েছে। কাজ হয়নি।” তাঁর অভিযোগ, হোমে চিকিৎসক দল চেয়ে জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিককে চিঠি দিয়েও লাভ হয়নি। সিএমওএইচ অজয়কুমার চক্রবর্তী অবশ্য বলেন, “চিঠি পাইনি। তবে আমরাই উদ্যোগ নিয়ে ছ’মাস ধরে স্থানীয় হাসপাতাল থেকে ওই হোমে সপ্তাহে একদিন চিকিৎসক দল পাঠাচ্ছি।”
গৃহহীন মানুষও কেন ওই হোমে থাকতে চান না, তা এ দিন স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর কাছে। তিনি বলেন, “দরজা খুলতেই উৎকট গন্ধে ঘরে ঢোকা যাচ্ছে না। আবাসিকরা উলঙ্গ অবস্থায় রয়েছে। প্রাগৈতিহাসিক যুগের চেয়েও আমনবিক অবস্থা। এই সব অসহায়, মানসিক ভারসাম্যহীন ভবঘুরেদের দিকে মানবিক দৃষ্টি দেওয়ার জন্য রাজ্যের কাছে অনুরোধ জানাই।”
|
অভাবের খতিয়ান |
• হোমের মোট জমির পরিমাণ ৪৫ একর। তার মধ্যে ৪০ একর জবরদখল হয়ে গিয়েছে।
• দরজা-জানালা ভাঙা, মেঝেতে শুতে হয় অধিকাংশ আবাসিককে।
• আবাসিকদের একটি বড় অংশ পোশাকের অভাবে বিবস্ত্র।
• ২১২ রোগীর জন্য তিন জন পুরুষ নার্স, মহিলা নার্স এক জন।
• হোমে শারীরিক বা মানসিক রোগের চিকিৎসক নেই।
• ২০১২ সালে ৩০ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ বছর মৃত অন্তত ১২ জন। |
|