ডুয়ার্সের জঙ্গল চিরে চলে গিয়েছে জাতীয় সড়ক। হু হু করে চলছে মারুতি ভ্যান। দু’হাতে স্টিয়ারিং ধরে রয়েছে মনিকা দর্জি। চুল উড়ছে হাওয়ায়, হাওয়া লেগে গাল লালচে।
কলকাতার রাস্তায় মেয়েদের গাড়ি চালানো পরিচিত দৃশ্য। কিন্তু ডুয়ার্সের চা বাগানে মেয়েদের দ্রুত হাতে চা পাতা তুলতে দেখতেই অভ্যস্ত সকলে। বাগানের চৌহদ্দির বাইরে মেয়েরা গাড়ি চালিয়ে ঘোরা মোটেই চেনা ছবি নয়। দয়ামতী প্রজা, ববিতা বসনেক, যাত্রী বড়া, বরুণা মুন্ডার মতো মেয়েরা সেই ছবিটাই বদলে দিচ্ছে। গাড়ি চালানোর ট্রেনিং নিয়ে ওরা চার জন পেয়ে গিয়েছেন লাইসেন্স। চেঙমারি চা বাগানের মনিকা অবশ্য এখনও শিখছে। আর ক’দিনে পাবে লাইসেন্স।
কেবল গাড়ি চালানো নয়, বিকল্প রোজগারের পথও খুঁজছে চা বাগানের মেয়েরা। হোটেল ম্যানেজমেন্টের মৌলিক কয়েকটি বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে ইতিমধ্যেই চাকরি পেয়েছে চার জন। তিন জন কলকাতায়, আর কুমলাই চা বাগানের তরুণী সুজাতা চিক বরাইক গ্যাংটকের একটি হোটেলে চাকরি পেয়েছেন। যাঁরা ড্রাইভিং শিখেছেন, তাঁদেরও কাজ দিতে আগ্রহ দেখিয়েছেন এলাকার মহিলা ডাক্তার, থানার পুলিশ, চা বাগানের কর্তারা। লাইসেন্স জুটলে কাজও জুটে যাবে, এমনই আশা ওদের। সামান্য কাজ, রোজগারও সামান্য। তবু চা বাগানের মেয়েদের কাছে এক অসামান্য সুযোগ। সুজাতার কথায়, “বাবা বাগানের কাজ করে যা টাকা পান তা মদের পেছনে খরচ করেন। তিন ভাই, দুই বোন, মা, কোনও কোনও দিন জল দিয়ে পেট ভরাই। এর মধ্যেই উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেছি। প্রশিক্ষণ নিয়ে কাজ করার সুযোগ না পেলে আমি দালালের সঙ্গে বাইরে চলে যেতাম।” |
মনিকাও জানায়, চরম অর্থাভাবে ক্লাস নাইন অবধি পড়ার পরে স্কুলে যেতে পারেনি ওরা দুই ভাইবোন। অভাবী বলে মাঝেমধ্যেই ভিন রাজ্যে কাজ পাইয়ে দেওয়ার টোপ দিয়ে দালালদের আনাগোনা চলত বাড়িতে। কিন্তু, বাগানের অনেক মেয়ে ভিন রাজ্যে গিয়ে হারিয়ে গিয়েছে। কারও খোঁজই মেলে না। আবার কেউ যখন ফেরে, তখন শারীরিক ও মানসিক ভাবে বিধ্বস্ত। এ সব ভেবে দোটানায় ছিল মনিকা।
চা বাগানে পাচার প্রতিরোধের জন্য কাজ করে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। দালালদের কার্যকলাপের বিষয়ে প্রচার করার জন্য সুজাতা, মনিকার মতো মেয়েদেরও সামিল করে ওই সংস্থা, ‘জবালা অ্যাকশন রিসার্চ।’ কিন্তু অভাবের সংসারে বিকল্প রোজগার কী হবে, সে প্রশ্ন তাড়া করতেই থাকে। জবালার তরফে রুবি বাগদাস জানান, চার মাস আগে ১৫জন মেয়েকে বেছে নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করা হয়। তাদের অনেকেই কাজ পেয়ে গিয়েছে। বাকিদের কাজ নিয়ে কথাবার্তা চলছে। “এখন ওদের আর পেছনে ফিরে তাকাতে হবে না,” বলেন রুবি।
ডুয়াসের্র প্রচুর বাগান রুগ্ন। শ্রমিকরা নিয়মিত রেশন বা বেতন পান না। সে বাগানগুলি থেকে পাচার চলছেই। জবালার জেলা কর্মকর্তা ফিরাজুল ইসলাম বলেন, গত বছরও ডুয়ার্সের নয়টি থানা এলাকার চা বাগান থেকে ৬১জন নারী পাচার হয়েছেন, যার মধ্যে আটজন নাবালিকা। এক বছরে ৪৫জনকে দিল্লি ও মুম্বইয়ের নিষিদ্ধ এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয়েছে। ‘ডুয়ার্স জাগরণ’ বলে অপর একটি সংস্থার পক্ষে ভিক্টর বসু জানালেন, তাঁদের হিসেব অনুসারে, ডুয়ার্সের ১৪টি চা বাগান থেকে ১৪জন নিখোঁজ হয়েছেন। গোটা ডুয়ার্সের চা বাগান ধরলে, নিখোঁজ মহিলা ও শিশুর সংখ্যা পাঁচশোরও বেশি। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার জেমস কুজুর দাবি করেন, “নানা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্যে পাচার কমানো গিয়েছে।” রাজ্যের শ্রম মন্ত্রী পূর্ণেন্দু বসুও বলেন, “ডুয়ার্সের বাগানে এক সময়ে ব্যাপক হারে নারী পাচার হত। আগের তুলনায় সে সংখ্যা কমেছে।” বিকল্প রোজগারের সুযোগ তৈরি করার কাজে শ্রম দফতর সহায়তা করবে বলে তিনি আশ্বাস দেন। জেলা পরিষদ সহ-সভাধিপতি জসিন্তা লাকড়া বলেন, বাগান থেকে নারী পাচার সমস্যা নিয়ে কী কী করা যায়, তাঁরা চিন্তা করছেন। “প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মেয়েদের কাজ দিতে যথাসাধ্য চেষ্টা করব,” বলেন তিনি। |