|
|
|
|
প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের ভূমিকায় বিতর্ক |
এক বছরে সাসপেন্ড ২০ জন শিক্ষক
আনন্দ মণ্ডল • তমলুক |
বধূ নির্যাতন, নাবালিকাকে বিয়ে করার অভিযোগ তো আছেই। এমনকী মধুচক্র চালানোর মতো অনৈতিক কাজের অভিযোগেও জড়িয়ে পড়ছেন প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা। এই সব নানা অনৈতিক কাজের অভিযোগে চলতি বছরে ২০ জন প্রাথমিক শিক্ষক-শিক্ষিকাকে সাসপেন্ড করেছে পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদ। এ ছাড়াও বিদ্যালয়ে সময়মতো না-আসা, সহ-শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার, পঠন-পাঠনে অবহেলা-সহ বিভিন্ন অভিযোগে ৩৯ জন শিক্ষক-শিক্ষিকাকে শো-কজ করেছে সংসদ। মাত্র এক বছরের মধ্যে এত জনের সাসপেন্ড হওয়ার পরিসংখ্যান সামনে আসায় প্রাথমিক শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। পাশাপাশি সংসদের কড়া ভূমিকা নিয়েও বিতর্ক শুরু হয়েছে শিক্ষক মহলে।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদের সভাপতি গোপাল সাহু অবশ্য বলেন, “নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত করেই সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। শিক্ষার মানোন্নয়নে কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়াও বিদ্যালয়ে সময়মতো না আসা, পঠন-পাঠনে অবহেলার অভিযোগে প্রায় ২০০ জন শিক্ষক-শিক্ষিকাকে সতর্ক করা হয়েছে।”
পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় ৩২৫৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় ১২ হাজার ২০০ জন শিক্ষক-শিক্ষিকা রয়েছেন। কিন্তু শিক্ষক-ছাত্রের অনুপাতে মোটেই সামঞ্জস্য নেই। কোনও স্কুলে একশো জন ছাত্রের জন্য মাত্র দু’জন শিক্ষক, কোথাও ৩০ জন ছাত্র পিছু ৪ জন শিক্ষক। এ ছাড়াও প্রাথমিক স্কুলের পরিকাঠামো নিয়েও নানা অভিযোগ রয়েছে লোকজনের। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ শিক্ষকদের নিয়ে। বিদ্যালয়ে সময়মতো না আসা, এলেও বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের আগে স্কুল ছুটি দিয়ে চলে যাওয়া, ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ানোয় অবহেলার মতো অভিযোগ হামেশাই ওঠে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে। এ সব ক্ষেত্রে প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনার দ্বায়িত্বে থাকা গ্রামশিক্ষা কমিটির বৈঠকে আলোচনা করে পদক্ষেপ করার সুযোগ থাকে। কখনও আবার সরাসরি জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদে অভিযোগ জানান গ্রামবাসীরা। সে ক্ষেত্রে প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদ তদন্ত করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে পারে। তবে, এ সব ক্ষেত্রে সাধারণত ডেকে সতর্ক করা হয়। চলতি বছরে যেমন প্রায় দু’শো জন শিক্ষককে সতর্ক করা হয়েছে।
সাসপেন্ডের বিষয়টি আরও গুরুতর। সাধারণত ফৌজদারি মামলায় জেলে গেলে সাসপেন্ড করা হয়। পূর্ব মেদিনীপুর জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদ সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১১ সালে জেলার ১২ জন প্রাথমিক শিক্ষক-শিক্ষিকাকে শো-কজ করা হয়েছিল। এর মধ্যে ৩ জনকে সাসপেন্ড করা হয়। ২০১২ সালে একই ভাবে জেলার মোট ৩০ জন শিক্ষক-শিক্ষিকাকে শো-কজ করা হয়। এর মধ্যে সাসপেন্ড করা হয়েছিল ৫ জন শিক্ষক-শিক্ষিকাকে। আর চলতি বছর অর্থাৎ ২০১৩ সালে এখনও পর্যন্ত জেলার ৩৯ জন শিক্ষক-শিক্ষিকাকে শো-কজ করা হয়েছে। এর মধ্যে সাসপেন্ড করা হয়েছে ২০ জন শিক্ষক-শিক্ষিকাকে। সাসপেন্ড হওয়া প্রাথমিক শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অধিকাংশই বিভিন্ন ফৌজদারি মামলায় অভিযুক্ত। কারও বিরুদ্ধে পণের জন্য বধূ নির্যাতন, কারও বিরুদ্ধে লুকিয়ে একাধিকবার বিয়ে, এমনকী মধুচক্র চালানোর অভিযোগও রয়েছে।
স্ত্রীকে নির্যাতনের অভিযোগে খেজুরি চক্রের এক প্রাথমিক শিক্ষককে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল। আদালতের নির্দেশে তাঁর জেল হেফাজত হয়। সরকারি নিয়ম মেনে ওই শিক্ষককে সাসপেন্ড করা হয়েছে। একই অভিযোগে নন্দীগ্রাম দক্ষিণ চক্রের এক প্রাথমিক শিক্ষককে সাসপেন্ড করা হয়েছে। বৌমাকে নির্যাতনের অভিযোগে কাঁথি পশ্চিম চক্রের এক প্রাথমিক শিক্ষিকার জেল হেফাজত হয়েছিল। আর কাঁথি পশ্চিম চক্রের এক শিক্ষক মধুচক্র চালানোর অভিযোগে জেল হেফাজতে যান। নিয়ম মেনে এদের প্রত্যেককে সাসপেন্ড করা হয়েছে বলে জেলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সংসদ কর্তৃপক্ষের দাবি। দু’-এক জনের ক্ষেত্রে শুধু দীর্ঘ দিন স্কুলে না-আসার মতো কারণে স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সাসপেন্ড করেছে সংসদ। সংসদ সভাপতি গোপাল সাহু বলেন, “আগে বাম আমলেও কোনও শিক্ষক জেলে গেলে সাসপেন্ড করা হত। তবে, ফৌজদারি মামলা খুবই কম হত বলে সাসপেন্ডও হত কম। এখন অপরাধ প্রবণতা বাড়ছে দেখে আমাদেরও কড়া হতে হচ্ছে।”
যদিও বর্তমান সংসদের ‘কড়া পদক্ষেপের যথার্থতা নিয়ে সংশয়’ প্রকাশ করেছেন প্রাক্তন সংসদ সভাপতি ওঙ্কারপ্রসাদ রায়। অন্য দিকে, কর্তব্যে অবহেলার অভিযোগে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সতর্ক করার নামে অযথা হয়রানির অভিযোগ করছে নিখিল বঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি (এবিপিটিএ)। তাদের অভিযোগ, সতর্ক করার সময় তৃণমূলের শিক্ষক সংগঠনে যোগ দেওয়ার জন্য পরোক্ষে চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। সংগঠনের জেলা সম্পাদক নুরুল হক বলেন, “অনেক ক্ষেত্রেই ভিত্তিহীন অভিযোগ আসে। গ্রামবাসীদের নাম করে স্বার্থান্বেষী কিছু লোকও অভিযোগ করে যায়। তাই কড়া পদক্ষেপের আগে ভাল করে তদন্ত করা প্রয়োজন বলে মনে করি। শিক্ষকদের সতর্ক করার নামে হয়রানির প্রতিবাদে আমরা সংসদে সম্প্রতি স্মারকলিপিও দিয়েছি।”
অভিযোগ উড়িয়ে গোপালবাবু বলেন, “আসলে বামফ্রন্টের আমলে ওদের লোকেদের বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ জানানোর সাহস পেত না। আর কেউ যদি সাহস করে অভিযোগও করত, পদক্ষেপ করা হত না। এখন গ্রামবাসীরা যেমন অভিযোগ জানাচ্ছেন, সংসদের তরফেও অভিযোগের তদন্ত করে দ্রুত পদক্ষেপ করা হচ্ছে। সেটা মানতে পারছেন না অনেকে।”
তরজা-পাল্টা তরজার মধ্যে উদ্বেগের চোরাস্রোতটা কিন্তু রয়েই যাচ্ছে। আর যাই হোক মধুচক্রের সঙ্গে কোনও শিক্ষকের নাম জড়ানোটা মোটেই বাঞ্ছনীয় নয়। |
|
|
|
|
|