ন’বছরের মেয়েটা ছটফট করে উঠল। ডাক্তারকে বলল, “আমার কেমোথেরাপির চ্যানেলটা চটপট করে দাও। আঁকার ক্লাস আছে বিকেলে। তার আগে একটু সুস্থ হতে হবে তো।”
ডাক্তার ডিসচার্জ সার্টিফিকেট লিখে দেওয়ার পরে কাঁদতে শুরু করল চার বছরের ছেলেটা। তিন দিন আগে শেষ হয়েছে তার কেমোথেরাপি। হাত নেড়ে সে বলল, “এখন বাড়ি যাব না। গেলে আমার নাচের ক্লাস বন্ধ হয়ে যাবে।”
১৫ বছরের কিশোর দু’লক্ষ টাকার চেকটা হাতে নিয়ে চুপচাপ বসে ছিল। বিশ্বাসই হচ্ছিল না এটা তার নিজের রোজগার। দিল্লিতে এক বহুজাতিক সংস্থা লিউকেমিয়া আক্রান্ত ওই কিশোরের আঁকা বড় ক্যানভাসের ছবি টাঙিয়ে রেখেছে তাদের দফতরে। ওই টাকা তারই সাম্মানিক দক্ষিণা। ঋত্বিক ঘোষ, ঈশা সাহান, সৃজন ওঝা, অঞ্জন শীল, অর্পণ সর্দার, অঞ্জলি রায়, শেখ আজহারউদ্দিন, আরও কত নাম! ক্যানসার রোগটার সঙ্গে সব সময়েই যে মুখ ভার করা, অন্ধকার ছবি জড়িয়ে থাকে, এদের জীবনের সঙ্গে তার কোনও মিল নেই। ওষুধ, ইঞ্জেকশন, রোগ যন্ত্রণায় ঘেরা ঘোর বাস্তবের পাশাপাশি এরা সকলেই একটা মুক্তির রাস্তা খুঁজে পেয়েছে। এবং এই ‘আর্ট থেরাপি’কে চিকিৎসার পাশাপাশি জীবন থেকে আনন্দ খুঁজে পাওয়ার একটা মাধ্যম বলে মনে করছেন চিকিৎসক মহলেরই একটা বড় অংশ। তাঁদের মতে, মনে আনন্দ থাকলে চিকিৎসায় সাড়া মেলার সম্ভাবনা বেশ খানিকটা বেড়ে যায়।
নাচ, গান, আঁকা, শরীরচর্চার হরেক ক্লাসের মাধ্যমে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্তদের মানসিক শক্তি জোগানোর এমন প্রয়াস পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ইতিমধ্যেই সফল বলে প্রমাণিত। হালে কলকাতাতেও শিশু ক্যানসার রোগীদের নিয়ে শুরু হয়েছে এমন কাজকর্ম শুরু। এক বেসরকারি হাসপাতালের আর্ট থেরাপিস্ট পাপড়ি সাহার কথায়, “গোড়ায় চিকিৎসকেরা কেউ মানতেই চাননি যে এর কোনও ইতিবাচক প্রভাব শিশুদের উপরে পড়তে পারে। কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁরাও বিষয়টি গ্রহণ করছেন। আর্ট থেরাপি যে একটি রুগ্ণ শিশুর উপর ম্যাজিকের মতো কাজ করতে পারে, ইতিমধ্যেই আমরা তা প্রমাণ করতে পেরেছি।” রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আর্ট থেরাপি নিয়ে পাশ করা পাপড়ি থেরাপির পাশাপাশি ওই শিশুদের ভবিষ্যৎ দিশা দেখানোরও চেষ্টা করছেন। |
বজবজের চড়িয়ালের বাসিন্দা অর্পণ সর্দারের বাড়িতে এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে ক্যানসার ধরা পড়েছিল। জীবনে কখনও তুলি না ধরা অর্পণকে আঁকায় হাতেখড়ি দেন পাপড়িই। সেই অর্পণের ছবি শুধু যে বাজারে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে তা-ই নয়, সে এখন স্বপ্ন দেখে ফের স্কুলে যাওয়ার, বড় হয়ে আর্ট কলেজে ভর্তি হওয়ার।
ঠাকুরপুকুরে এক বেসরকারি ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্রে আর্ট থেরাপির ক্লাস চলে অর্পণের। তার অধিকর্তা অর্ণব গুপ্ত বলেন, “পরীক্ষামূলক ভাবে এটা চালু করেছিলাম। হাতেনাতে ফল মিলছে। রোগযন্ত্রণা কমানো যাক বা না যাক, বাচ্চাগুলোকে খুশি রাখতে পারা যাচ্ছে, এটাই সবচেয়ে বড় কথা। রোগের সঙ্গে লড়ার শক্তি পাচ্ছে ওরা।”
ক্যানসার চিকিৎসক সোমা দে-র কথায়, “কেমোথেরাপির আগে বাচ্চাগুলোর কাউন্সেলিং করতে হত। এখন ওরা ও সব নিয়ে মাথাই ঘামায় না। কেমোথেরাপির পরেও ছবি আঁকে, গান গায়। রোগের বাইরেও যে অন্য একটি জগৎ রয়েছে, সেটা ওরা বুঝতে পারছে। তাই ওষুধ-ইঞ্জেকশনের পাশাপাশি এই প্রক্রিয়াকে যথেষ্ট স্বাগত জানাচ্ছি।” ওই শিশুদের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, গভীর অবসাদে ডুবে থাকত তাদের অধিকাংশই। হাঁটতে পারত না। কারও সঙ্গে কথা বলত না। তারা অনেকেই এখন হেঁটেচলে বেড়াচ্ছে, হাসছে, গল্প করছে, দীপাবলীর আগে প্রদীপ তৈরি করছে, রাখীপূর্ণিমার আগে রাখী বানাচ্ছে।
ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়ের কথায়, “অসুস্থ হলে মানসিক শক্তি এমনিতেই কমে যায়। তাই চিকিৎসায় সাড়া পেতে সময় লাগে। রোগীর মনকে চাঙ্গা করার প্রয়োজনীয়তা গোটা বিশ্ব জুড়ে স্বীকৃতি পাচ্ছে। ক্যানসার চিকিৎসায় এর গুরুত্ব খুবই বেশি।”
একই অভিমত ক্যানসার চিকিৎসক গৌতম মুখোপাধ্যায়েরও। তাঁর কথায়, “চিকিৎসায় আলাদা করে সাড়া মিলছে কি না তার পরিসংখ্যান এখনও মজুত নেই। কিন্তু আর্ট থেরাপি চললে রোগীরা ওষুধের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া কম অনুভব করেন, সহনশক্তি বাড়ে। মনটাও অন্য দিকে যায়। আর লড়াকু মেজাজ থাকলে চিকিৎসা সম্পূর্ণ করতে সুবিধা হয়।” |