এক সময় মস্ত বাড়ি ছিল। এলাকায় লোকে জানত ‘মিঞাবাড়ি’ বলে। সে সবই অতীত।
কিন্তু জমিদারি তো রক্তে।
জামাল শেখের ‘জলসাঘরে’ এখনও বাঁধা থাকে ঘোড়া। সেই ঘোড়ার পিঠে চড়েই তিনি যান বোলপুর থেকে কাটোয়া। ঘোড়া পোষার এই নেশার জন্য স্থানীয় বাসিন্দারা তাঁকে ডাকেন ‘ঘোড়াবাবু’ নামে। ছোটরা ডাকে ‘ঘোড়াদাদু’।
জামাল শেখের বাড়ি বর্ধমানে কেতুগ্রাম ১ ব্লকের মাসুন্দির কাছে রাজখাঁড়ায়। কিন্তু তাঁর ঘোড়ার শখের কথা এলাকা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে ব্লক সদর কান্দরা, এমনকি বীরভূমের নানুরেও। এখনও পর্যন্ত জামালবাবু পাঁচ-ছ’টি ঘোড়া কিনেছেন। তাদের পরিচর্যাও করেন নিজের হাতে। তবে আক্ষেপ যায় না “কত দিন ধরে আমার শখ, একটা রেসের ঘোড়া কিনব। কিন্তু টাকার অভাবে সেই ইচ্ছেপূরণ হবে না।” যদিও রেসের ঘোড়া কিনলে যে তিনি তাকে ঘোড়দৌড় করাবেন, তা আদৌ নয়। বরং তাঁর ইচ্ছে, সাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পড়ে, গায়ে আতর লাগিয়ে জমিদারি মেজাজ নিয়ে এলাকায় ঘুরবেন। তাঁর কথায়, “প্রায়ই রাতে এ রকম একটা স্বপ্ন দেখি। মনটা ভাল হয়ে যায়। |
আশপাশে সকলেই যখন বাস-গাড়ি, মোটরবাইক, নিদেনপক্ষে সাইকেলে চড়ে, আপনার কেন ঘোড়া বাহন? জামাল শেখের জবাব, “সেই ছোট বয়স থেকে আমার ঘোড়ার শখ। হাতেখড়ি পিসেমশাইয়ের ঘোড়ায়। সেই থেকেই নেশা ধরে গেল।” সেই নেশা এমনই যে, প্রায় ৪০ বছর আগে বিহারের কিষাণগঞ্জের একটি বেকারিতে কাজ করার সময় যে মজুরি পেতেন, তার থেকেই টাকা জমিয়ে ঘোড়া কিনেছিলেন।
গ্রামের গোড়েপুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ বলে চলেন, “এক সময়ে এই পুরো এলাকা জুড়ে আমাদের ‘মিঞাবাড়ি’ ছিল। জমিদার বলে সম্মান ছিল। এক দিন সব চলে গেল। মিঞা থেকে শেখ হয়ে গেলাম।” বাড়ি লাগোয়া এক চিলতে জায়গায় এখন তাঁদের আস্তাবল। তার পাশেই দেওয়াল থেকে খসে পড়ছে মাটি। সে দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধের গলায় ঝরে আক্ষেপ “এই তো আমাদের জমিদারির নমুনা। মাটির বাড়ি সারানোর ক্ষমতাও নেই।”
এখন জামাল শেখের প্রিয় ঘোড়া হল ‘রাজ’। বছর দুয়েক আগে কয়েক হাজার টাকা দিয়ে ঘোড়াটি কিনেছিলেন। তাকে আদর করতে করতে তিনি বলেন, “একে দু’বেলা ভাল করে খেতে দিতেই পারি না। দু’মুঠো খেতে দিতে পারলে দেখতেন কেমন ছুটত।” রাজকে নিয়ে তিনি মাঝে-মাঝে হাওয়া খেতেও বেরোন। ঘোড়ায় চড়ার জন্য তাঁর আলাদা পোশাক রয়েছে। তা তোলা থাকে। যে দিন ঘোড়ায় চড়েন, সে দিন ওই পাজামা-পাঞ্জাবি পরে বেরোন। কোনও কোনও দিন সঙ্গে থাকেন গ্রামের সাহিল শেখ।
জামাল শেখের স্ত্রী মলুদা বিবি জানান, প্রায় সাঁইত্রিশ বছরের বিবাহিত জীবনে তিনি ঘোড়া ছাড়া আর কিছু পোষেননি। তাঁর কথায়, “অনেক লোকে মাল বওয়ার জন্য ঘোড়া পোষে। উনি পুষছেন শখে।” ভাঁড়ারে টান পড়ে না? বাড়িতে অশান্তি হয় না? দীর্ঘশ্বাস ফেলে মলুদা বিবি বলেন, “ঘরে খাবার নেই। অথচ উনি ঘোড়া কিনে ফেললেন। আগে এই নিয়ে বলতাম। কিন্তু এক বার টাকার অভাবে ঘোড়া কিনতে না পেরে উনি প্রায় পাগল হয়ে গিয়েছিলেন। তার পর থেকে আর কিছু বলি না।”
মলুদা বিবির বড় ছেলে মতিয়ার রহমান বলেন, “আমরা দিন আনি, দিন খাই। তা সত্ত্বেও বাবার শখ বজায় রাখার চেষ্টা করছি।” গ্রামের রতন শেখ, নূর হক শেখরা বলেন, “শুধু শখে যে ঘোড়া কেনা যায়, সেটা জামাল চাচাকে দেখেই জানলাম।” ‘জলসাঘর’-এর বিশ্বম্ভর রায়কে মনে নেই? ক্ষয়িষ্ণু জমিদার বাড়িতেও যিনি মর্যাদার ঝাড়বাতি জ্বালান আর চকিতে ছুটিয়ে দেন ঘোড়া? জমিদারি যাঁর রক্তে, মেজাজটাই তো তাঁর সব। |