চোখে চোখ রেখে কথা বলতে অস্বস্তি। বোঝে না স্পর্শের অর্থও। সামাজিক মেলামেশার আগ্রহ বা বোধ, কোনওটাই সাধারণ পাঁচ জনের মতো নয়। চিকিৎসকদের ভাষায় সমস্যাটির নাম ‘অটিজম স্পেকট্রাম ডিসঅর্ডার’ বা এএসডি। এর কোনও ওষুধ এখনও আবিষ্কার হয়নি। তবে এই সমস্যায় ভোগা শিশু-কিশোরদের মূল স্রোতে আনার চেষ্টায় এক চিলতে আশার আলো দেখাচ্ছে প্রেমের হরমোন।
বিজ্ঞানের ভাষায় পিটুইটারি গ্রন্থি থেকে বেরনো এই হরমোনের নাম অক্সিটোসিন। এএসডি-তে ভোগা ১৭ জন কিশোর-কিশোরীর ক্ষেত্রে এর কার্যকারিতা নিয়ে পরীক্ষা চালিয়ে আমেরিকার ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ইলানিত গর্ডন ও তাঁর সহকারীরা উৎসাহজনক ফল পেয়েছেন। তাঁদের গবেষণাপত্রটি সম্প্রতি ‘জার্নাল প্রসিডিংস অব দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস’-এ প্রকাশিত হয়েছে। অধ্যাপক গর্ডন তাতে জানিয়েছেন, সাধারণ ভাবে মস্তিষ্কের যে সব অংশ সামাজিক ভাবনা, চিন্তা ও বোধ নিয়ন্ত্রণ করে, এএসডি আক্রান্তদের ক্ষেত্রে সেই সব এলাকার সক্রিয়তা বাড়িয়ে তুলতে পারে অক্সিটোসিন।
লাভ কী তাতে? সেটা বুঝতে হলে, এএসডি আক্রান্তদের সমস্যাগুলির কথা ভাবা যেতে পারে। ‘রেনম্যান’ ছবির রেমন্ড ব্যাবিট কিংবা ‘মাই নেম ইজ খান’-এর রিজওয়ান খানকে মনে আছে? আশপাশের মানুষদের আবেগ, অনুভূতি সব কিছুই কেমন যেন দুর্বোধ্য তাদের কাছে। বাস্তবের এএসডি আক্রান্তদের সমস্যাটাও ঠিক এখানেই। সামাজিক পরিস্থিতি, মানবিক আবেগ, কিছুই ঠিকঠাক বুঝে উঠতে পারে না এরা। অধ্যাপক গর্ডনের বক্তব্য, অক্সিটোসিনই এই সমস্যার সমাধান, এখনই এমন কথা বলা না গেলেও এই ক্ষেত্রে একটা দিশা অন্তত পাওয়া গিয়েছে, এটুকু বলা যেতেই পারে।
পরীক্ষার জন্য আট থেকে সাড়ে ষোলো বছর বয়সী ১৭ জন এএসডি আক্রান্তকে বেছে নিয়েছিলেন গর্ডনরা। কয়েক জনের নাকে অক্সিটোসিন স্প্রে করা হয়, কয়েক জনকে দেওয়া হয় প্লাসেবো (সাধারণ গ্যাস)। মিনিট ৪৫ পর তাদের মস্তিষ্কের সক্রিয়তার ছবি (এফএমআরআই) তোলা হয়। এ বার দেখা হয়, সামাজিক দিক থেকে অর্থপূর্ণ এবং সামাজিক দিক থেকে অর্থপূর্ণ নয় এমন দু’টি ভিন্ন পরিস্থিতিতে দু’দল শিশু-কিশোরের কী প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। সব শেষে মিলিয়ে দেখা হয় দু’টি পরীক্ষার ফলাফল। দেখা যায় মস্তিষ্কের যে সব অঞ্চল সামাজিক ভাবনা, চিন্তা, বোধ ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে, অক্সিটোসিন দেওয়ার পরে সেই অংশগুলির সক্রিয়তা বেড়ে গিয়েছে। সামাজিক দিক দিয়ে অর্থহীন পরিস্থিতির তুলনায় অর্থপূর্ণ পরিস্থিতিতে অনেক বেশি সক্রিয় থাকে ওই অংশগুলি। এর ভিত্তিতেই গর্ডনদের দাবি, অক্সিটোসিন দিয়ে সামাজিক মেলামেশায় এএসডি আক্রান্তদের জড়তা কাটানো যেতে পারে অনেকটাই।
গর্ডনদের এই পরীক্ষা সম্পর্কে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নায়ুবিজ্ঞানী অধ্যাপক তুষার ঘোষ বলেছেন, “অক্সিটোসিন শুধু হরমোন নয়। নিউরোট্রান্সমিটারও বটে। এটি যে নানা ধরনের সামাজিক ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করে, ইতিমধ্যেই তা প্রমাণিত হয়েছে। প্রেমের অনুভূতির ক্ষেত্রেও প্রভাব খাটাতে পারে অক্সিটোসিন। সে সব মাথায় রাখলে গর্ডনদের দাবি অস্বাভাবিক কিছু নয়।”
গর্ডনদের এই পরীক্ষা নিয়ে কয়েকটি প্রশ্নও তুলেছেন তুষারবাবু। তাঁর বক্তব্য, “অক্সিটোসিন স্প্রে নিয়ে সাময়িক ভাবে এএসডি আক্রান্তদের উপকার হলেও দীর্ঘমেয়াদি লাভ হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যাচ্ছে। কারণ, এএসডি আক্রান্তদের স্নায়ু সংযোগেই কিছু গড়বড় থাকে। যা অক্সিটোসিন দিয়ে সারানো সম্ভব নয়। তা ছাড়া, বয়ঃসন্ধির পর বাইরে থেকে অক্সিটোসিন ঢোকালে শরীরে তার ক্ষতিকর প্রভাবও পড়তে পারে বলে মনে করিয়ে দিয়েছেন তুষারবাবু।
প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরবিদ্যার অধ্যাপক দেবাশিস সেনও এত দ্রুত কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছতে রাজি নন। তাঁর মতে, “মাত্র ১৭ জনের উপর পরীক্ষা চালিয়ে এত বড় সিদ্ধান্তে পৌঁছনো সম্ভব নয়।” পরীক্ষার এই পর্যায়েই যে নিশ্চিত কোনও সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়, সে কথা অবশ্য স্বীকার করছেন গর্ডনরাও। আশার অক্সিটোসিনকে ঘিরে তাই পরীক্ষা চলছেই। |