নুরের মতো অভিযুক্ত হওয়ার নজির বিরল
ক্ষক হওয়ার অভিযোগে রক্ষকের গ্রেফতার হওয়ার ঘটনা নতুন নয়। লুঠপাট, ডাকাতি, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, ভয় দেখিয়ে টাকা তোলা বা অন্যায় সুবিধে দেওয়ার বিনিময়ে উৎকোচ গ্রহণ-সহ বিভিন্ন অভিযোগে এর আগে গ্রেফতার হয়েছেন পুলিশ অফিসার ও কর্মী। বহু পুলিশ অফিসারকে গ্রেফতার করা হয়েছে দুর্নীতি দমন আইনে। রিজওয়ানুর কাণ্ডে আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল এক আইপিএস-সহ তিন পুলিশ অফিসারের বিরুদ্ধে। কিন্তু শর্ট স্ট্রিট কাণ্ডে সাব-ইন্সপেক্টর নুর আলিকে যে অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছে, তা অতীতের প্রায় সব ঘটনাকে ছাপিয়ে গেল বলে মানছে পুলিশেরই একাংশ।
শুক্রবার রাতে গ্রেফতার হওয়া এসআই নুর আলির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি শর্ট স্ট্রিটের ওই বিতর্কিত জমিতে বহিরাগতদের দিয়ে হামলা চালানোর ষড়যন্ত্রে প্রত্যক্ষ ভাবে জড়িত। ১১ নভেম্বর সকালে ওই হামলার জেরেই পর পর গুলি চলে ও নিহত হন দু’জন। ওই ঘটনার সময়ে নুর আলি ছিলেন শেক্সপিয়ার সরণি থানার সাব-ইন্সপেক্টর। কোনও থানার অফিসারের বিরুদ্ধে সেই থানা এলাকারই এত বড় ঘটনায় সরাসরি জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠার দৃষ্টান্ত কলকাতা পুলিশের ইতিহাসে আর আছে কি না, প্রাক্তন ও বর্তমান পুলিশকর্তারা মনে করতে পারছেন না। শুধু তা-ই নয়, শর্ট স্ট্রিটের ওই ঘটনায় রুজু হওয়া দু’টি মামলার একটির তদন্তকারী অফিসার প্রথমে ছিলেন নুর। এক আইপিএস অফিসার বলেন, “তদন্তকারী অফিসারেরই ফৌজদারি মামলায় গ্রেফতার হওয়ার নজির তেমন নেই।”
শনিবার দুপুরে ব্যাঙ্কশাল আদালতে হাজির করানো হলে নুরকে বিচারক ১৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত পুলিশি হেফাজতে রাখার নির্দেশ দেন। তাঁকে নিয়ম মাফিক পুলিশের চাকরি থেকে সাসপেন্ড করা হয়েছে। তদন্তকারীরা জানিয়েছেন, নুরকে দিয়ে বিচারকের কাছে গোপন জবানবন্দি দেওয়ানোর প্রস্তুতি চলছে।
তবে কলকাতা পুলিশের একটা বড় অংশের দাবি, শুধু এক জন সাব-ইন্সপেক্টরকে ধরলেই চলবে না, এই ঘটনায় আরও উচ্চপদস্থ যে সব অফিসারের নাম উঠে এসেছে, তাঁদের বিরুদ্ধেও সম পর্যায়ের আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। গোয়েন্দা সূত্রের খবর, জেরার মুখে নুর তাঁর সঙ্গে চক্রান্তের ভাগীদার হিসেবে এক ইন্সপেক্টর ও এক অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনারের নাম করেছেন। তদন্তকারীদের কাছে নুরের দাবি, বিতর্কিত জমিতে বহিরাগতদের দিয়ে হামলার ছক তৈরির মাথা পরাগ মজমুদার ও তাঁর সহযোগীরা পুলিশকে হাতে রাখতে তিন দফায় যে টাকা দিয়েছিল, তার সামান্যই তিনি পেয়েছেন। বেশির ভাগই ঢুকেছে তাঁর ওই দুই উপরওয়ালার পকেটে। লালবাজার সূত্রের খবর, শর্ট স্ট্রিট কাণ্ডের সময়ে শেক্সপিয়ার সরণি থানার যিনি ওসি ছিলেন, সেই পীযূষ কুণ্ডুকে দু’-এক দিনের মধ্যেই লালবাজারে ডেকে জেরা করা হবে।
এ দিন পীযূষ কুণ্ডু বলেন, “নিজে ফেঁসে গিয়ে নুর আলি এখন অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাতে চাইছেন। আমাকে লালবাজারের তদন্তকারীরা ডাকলে আমি নিশ্চয়ই সেখানে গিয়ে সব কিছু জানাব। নুর আলি যা করেছেন, নিজ দায়িত্বে করেছেন।” কিন্তু থানার এক জন এসআই যেখানে হামলাকারীদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে সামিল, সেখানে থানার ওসি হিসেবে তিনি কি দায়িত্ব এড়াতে পারেন? পীযূষবাবুর মন্তব্য, “থানার প্রতিটি অফিসার কী করে বেড়াচ্ছেন, তা জানা ওসি-র পক্ষে সব সময়ে সম্ভব হয় না।”
প্রসঙ্গত, শর্ট স্ট্রিট কাণ্ডের তদন্তে সন্দেহজনক ভূমিকার কথা জানার পরেই এসআই নুরকে যেমন থানা থেকে সরিয়ে সাউথ ডিভিশনের রিজার্ভ অফিসে ‘ক্লোজ’ করা হয়েছিল, তেমনই ওসি পীযূষ কুণ্ডুকে থানা থেকে বদলি করা হয় সিকিওরিটি কন্ট্রোলে এবং এসি তাপস বসুর হাত থেকে শেক্সপিয়র সরণি ও পার্ক স্ট্রিট থানার দায়িত্ব কেড়ে নেওয়া হয়। তাপসবাবু বলেন, “থানার প্রশাসনে এসি-র ভূমিকা একেবারেই নগণ্য। এক জন এসি হিসেবে আমি এর মধ্যে আসছি কী করে? নুর আলি মিথ্যা বলছেন।”
লালবাজারের এক শীর্ষকর্তার কথায়, “জেরায় নুর নাম বলেছেন বলেই কিন্তু কোনও পুলিশ অফিসারকে গ্রেফতার করা সম্ভব নয়। আমরা সাবধানে এগোচ্ছি। বিষয়টি স্পর্শকাতর। সেই অফিসারের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ পেতে হবে।”
নুর আলির বিরুদ্ধে তা হলে কী প্রমাণ পাওয়া গিয়েছিল?
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, শর্ট স্ট্রিটের জমি দখল করার উদ্দেশ্যে ১১ নভেম্বরের আগে ১৫ সেপ্টেম্বরও বহিরাগতরা হামলা চালায়। সে বারের হামলার আগে ই এম বাইপাসের ধারের একটি হোটেলে হামলার মূল চক্রী পরাগ মজমুদার, এই কাণ্ডে তাঁর সহযোগী আইনজীবী সামির রিয়াজের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন নুর। পরাগ ও সামির দু’জনকেই শর্ট স্ট্রিট কাণ্ডে গ্রেফতার করা হয়েছে। হোটেলের ওই বৈঠকের সিসিটিভি ফুটেজ এখন গোয়েন্দাদের হাতে।
জেরায় প্রথমে নুর আলি ষড়যন্ত্রে তাঁর জড়িত থাকার অভিযোগ ক্রমাগত অস্বীকার করলেও ওই ফুটেজ দেখাতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন এবং সব কিছু স্বীকার করে নেন বলে তদন্তকারীদের দাবি। তা ছাড়া, ১১ নভেম্বরের ঘটনার আগের দিন থেকে ঘটনার পর পর্যন্ত সব মিলিয়ে নুরের সঙ্গে সামির রিয়াজের মোবাইলে দেড়শো বারেরও বেশি কথা হয়! সেই কথোপকথনের প্রমাণ হিসেবে মোবাইলের কল ডিটেলস রেকর্ড-ও গোয়েন্দারা জোগাড় করেছেন। তদন্তকারীরা জেনেছেন, পুলিশকে হাত করার জন্য সামির রিয়াজের মাধ্যমেই টাকা দিয়েছিল হামলার চক্রীরা। সে জন্য নুর ও সামিরকে মুখোমুখি বসিয়ে জেরা করতে চাইছেন গোয়েন্দারা।
তদন্তকারীরা আরও জেনেছেন, ১৫ সেপ্টেম্বরের হামলায় ৯-এ শর্ট স্ট্রিটে রতনলাল নাহাটার ঘর থেকে একটি আগ্নেয়াস্ত্র খোয়া যায়। ওই জমিতে দীর্ঘ দিন ধরে বসবাসকারী রতনলাল নাহাটা সেখানে যাঁকে ছোটদের স্কুল করতে দিয়েছিলেন, সেই মমতা অগ্রবাল তখন কলকাতায় ছিলেন না। তিনি দুবাইয়ে ছিলেন। কলকাতায় ফিরে থানায় গিয়ে মমতা সেই আগ্নেয়াস্ত্রের লাইসেন্স জমা দেন। গোয়েন্দাদের দাবি, বিভাগীয় ডিসি-র কাছে থানার ওসি পীযূষ কুণ্ডু এবং সেই হামলার ঘটনারও তদন্তকারী অফিসার নুর আলি গোড়া থেকেই প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেন, মমতা মিথ্যা বলছেন। মমতা যে থানায় গিয়ে তাঁর বক্তব্যের প্রমাণ স্বরূপ লাইসেন্স জমা দিয়ে গিয়েছেন, সে কথা ডিসি-র কাছে পীযূষবাবু ও নুর চেপে যান বলে গোয়েন্দাদের দাবি।
এই ব্যাপারে পীযূষ কুণ্ডু বলেন, “আগ্নেয়াস্ত্র খোয়া গিয়ে থাকলে তার লাইসেন্স তদন্তকারী অফিসারকে জমা দেওয়ার কথা। আমি কিছু জানি না। লাইসেন্স জমা দিয়ে থাকলে সেটা গোপন করাই বা কী তবে লালবাজারের এক প্রাক্তন শীর্ষকর্তা বলেন, “বিবদমান দু’পক্ষের কোনও এক জনকে বিতর্কিত জমির দখল জবরদস্তি পাইয়ে দিতে পুলিশ তার থেকে টাকা নিচ্ছে, এমন ঘটনা বিরল নয়। আসলে কেউ জানতে পারে না। কিন্তু শর্ট স্ট্রিটে খোদ পুলিশ কমিশনারের বাংলোর পাশেই গুলি চলা ও দু’জনের নিহত হওয়ার ঘটনাতেই জল এত দূর গড়াল।”
 
 
 


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.